• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপ্রতিরোধ্য মোটরসাইকেলে ছিনতাই চক্র


একে সালমান
প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১, ০২:৩৭ পিএম
অপ্রতিরোধ্য মোটরসাইকেলে ছিনতাই চক্র

মাহমুদা বেগম রাত ৮টায় অফিস শেষ করে রিকশায় ঝিগাতলার বাসায় যাচ্ছিলেন। নিউমার্কেট পার হয়ে সিটি কলেজের সামনে আসতেই পেছন থেকে দ্রুত গতির একটি মোটরসাইকেল এসে হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাঁধের ব্যাগটি নিয়ে যায়। ব্যাগের ভেতরে থাকা মোবাইল, টাকা এবং জরুরি কাগজপত্র চোখের পলকে ছিনতাই হওয়ায় রাস্তায় বসে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তার মধ্যেই গড়াগড়ি দেওয়া শুরু করেন। মোটরসাইকেলে করে এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা নগরীতে এখন প্রতিদিনের খবর।

সম্প্রতি রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাথায় হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে এসে ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। এমন ভয়ঙ্কর একটি সংঘবদ্ধ চক্রের খোঁজ পাওয়া যায়।  

এই চক্রটি রাজধানীসহ সারাদেশে বুক ফুলিয়ে ছিনতাই করে যাচ্ছে। শুধু রাতের আঁধারে নয়, দিনে বেলায় সূর্যের আলোতেও এরা ছিনতাই করতে পারদর্শী। এদের ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। দ্রুত গতিতে পেছন থেকে এসে ব্যাগ ধরে টান দেওয়ার কারণে অনেকে রিকশা বা গাড়ী থেকে নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে মারা গেছেন।

ছিনতাইকারীদের মাথায় হেলমেট থাকার কারণে এদের চিহ্নিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালানো এবং অনেক গাড়িতে নম্বর প্লেট না থাকার কারণে বিভিন্ন বাসা বাড়ি বা রাস্তায় থাকা সিসি ক্যামেরা দিয়েও এদের সহজে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। 

যে এলাকাগুলো হটস্পট হিসেবে পরিচিত 

রাজধানীর গুলিস্তান, স্টেডিয়াম মার্কেট, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড, ইংলিশ রোড, তাঁতীবাজার মোড়, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, কারওয়ান বাজার মোড়, ফার্মগেট বাস স্ট্যান্ড, খামারবাড়ি মোড়, শ্যামলী বাস স্ট্যান্ড, ধানমন্ডি-২৭ মোড়, শঙ্কর বাস স্ট্যান্ড, সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়, নিউমার্কেট, কুড়িল বিশ্বরোড, এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ড, মগবাজার মোড় এবং মালিবাগ বাসস্ট্যান্ডসহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকা রয়েছে। 

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে ফার্মগেট, শ্যামলী, গুলিস্তান, কুড়িল বিশ্বরোড এবং এয়ারপোর্ট এলাকাতে। এই এলাকাগুলোর মধ্যে প্রতিদিন আট থেকে দশটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।  

ভুক্তভোগীর বক্তব্য

ভুক্তভোগীরা জানান, রিকশা, সিএনজি চালিত অটো রিকশা, এমনকি হেঁটে যাওয়ার সময় পেছন থেকে হঠাৎ করে মোটরসাইকেল এসে হাতে থাকা মোবাইল অথবা কাঁধের ব্যাগ টান দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেলে থাকায় দৌড়ে আটক করা সম্ভব হয় না। এছাড়া, থানায় মামলা বা জিডি করতে গেলেও তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। 

মোটরসাইকেল চক্রের কাছে ছিনতাই শিকার হওয়া মোস্তফা হোসেন জানান, “আমি আসাদগেট দিয়ে রিকশায় অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল এসে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমার কাঁধে থাকা ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। আসাদগেটের সিগনালে এসে দৌড়ে তাদের ধরতে পারিনি। মোহাম্মদপুর থানায় এসে পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর আমাকে থানায়  অভিযোগ দিতে বললে আমি থানায় অভিযোগ দায়ের করি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে মোহাম্মদপুর থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। 

একই স্থানে মোটরসাইকেল বাহিনীর হাতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া। তিনি জানান, আমরা তিন বান্ধবী রিকশায় যাচ্ছি। এমন সময় ফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল এসে আমার মোবাইল ফোনটি টান দিয়ে নিয়ে যায়। আমি পেছন থেকে জোরে চিৎকার করতে থাকি। চিৎকার করেও কোনো কাজ হয়নি। তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। মোটরসাইকেলে থাকা দুজনেরই মাথায় হেলমেট  ছিলো। তাই তাদের কাউকে চিনতে পারিনি। থানায় গিয়ে পুলিশকে জানালে, পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দেখে যায়। পরে আমরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে বাসায় চলে আসি। 

কুড়িল বিশ্বরোডের বাসিন্দা মোবাশ্বের হোসেন জানান, আমি বাসে বসে ফোনে কথা বলছিলাম। হঠাৎ মনে হলো পেছন থেকে কে যেন ফোনটি টান দিয়ে নিয়ে গেলো। পেছনে তাকাতেই দেখি একটা মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে দুইজন লোক বসে আছে। তারা আমার ফোনটি হাত থেকে টান দিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বাস থেকে দ্রুত দৌড়ে নেমে তাদের আর ধরতে পারিনি। তারা মোটরসাইকেলের গতি আরো বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায়।

মালিবাগের বাসিন্দা উম্মে হাবিবা জানান, আমি সন্ধ্যার পর মালিবাগ হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের গলি দিয়ে রিকশা করে বাসায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা মোটরসাইকেল এসে আমার কাঁধে থাকা ব্যাগের ফিতা ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে যায়। এ সময় আমার গালে ছুরি লেগে অনেক জায়গা কেটে যায়। আশেপাশের মানুষ আমার এমন অবস্থা দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন

একটি দ্রুত গতির মোটরসাইকেল এসে হঠাৎ করেই রিকশায় বা হেঁটে যাওয়া পথচারীর মোবাইল, ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছিনতাইকারীরা দ্রুত মোটরসাইকেল চালানোর কারণে আমরা দৌড়ে ধরার আগেই তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে। আমরা ধাওয়া করেও তাদের আটক করতে পারি না। রাস্তায় থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো যদি ঠিক মতো মনিটরিং করা যেতো, তাহলে ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করে আটক করা যেতো। অনেক এলাকায় দেখা যায়, কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে কয়েকজন উঠতি বয়সী তরুণ মহড়া দেয়। ঠিক রাত হলেই ঐ এলাকাগুলোর মধ্যে ছিনতাই ঘটতে দেখা যায়।
 
পুলিশের তথ্য মতে, গত এক মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, মৌচাক, মোহাম্মদপুর, শেরে বাংলা নগর, ধানমন্ডি এবং তেজগাঁওসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় দেড় শতাধিক মোটরসাইকেল বাহিনীর হাতে এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশ যা বলছে

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, রাজধানীতে এমন একটি চক্রের কবলে পড়ছে অনেকে। এ ঘটনার পেছনে আসলে মাদকসেবীরা রয়েছে। তারা মূলত মাদকের টাকা জোগাড় করার জন্য ছিনতাই করে বেড়ায়। এমন সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময় আমরা অনেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করছি প্রতিনিয়ত।  

এছাড়া, সাধারণ মানুষের সাবধানতা খুব বেশি জরুরি। কেননা, আমরা রাস্তায় যাতায়াতের সময় যদি একটু সাবধানে চলাফেরা করি তাহলে হয়তো এমন ছিনতাই থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি পরিবহনে চলার সময় জানালার পাশে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যেসব এলাকায় জনসমাগম কিংবা দোকানপাট বেশি, সে এলাকাগুলোতে অনেক বেশি সাবধান হওয়া জরুরি। তাহলেই আমরা এমন ছিনতাই থেকে বাঁচতে পারবো।
 

Link copied!