প্রতিবছরের মতো এবারও বছরের প্রথম দিন উৎসবের মধ্য দিয়ে সরকারের বিনা মূল্যের বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এবার সব শিক্ষার্থী তাদের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সব বই হাতে পায়নি। আপাতত তাদের পুরো সেটের মাত্র একটি বা দুটি বই দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় আবার একটি বইও পায়নি শিক্ষার্থীরা। এমনকি বইয়ের সরবরাহ না থাকায় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই উৎসবও হয়নি।
এদিকে যারা বই পেয়েছে, সেই বইগুলো নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। নিম্ন মানের কাগজ, বানান ভুল, বাক্য গঠনে ভুল—এ রকম অনেক অভিযোগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। ছাপার মান নিয়েও অভিযোগ করতে দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থীকে। এসব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ষষ্ঠ শ্রেণির তিনটি গল্প আবারও দেওয়া হয়েছে সপ্তম শ্রেণিতে। যেমন সৈয়দ শামসুল হকের ‘কত দিকে কত কারিগর’, শওকত ওসমানের ‘তোলপাড়’ ও আনিসুজ্জামানের ‘কত কাল ধরে’— এই তিনটি গল্প ষষ্ঠ শ্রেণিতে যেমন ছিল, এ বছর নতুন কারিকুলামের সপ্তম শ্রেণিতেও চলে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে শহীদ মনু মিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী লোকমান হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলে, “একই গল্প তো বারবার পড়তে কারও ভালো লাগে না। তা ছাড়া বইয়ের পৃষ্ঠা দেখে বুঝতে পারছি না বই পড়ব নাকি খবরের কাগজ পড়ব?”
এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, “আমরা নতুন কারিকুলাম (শিক্ষাক্রম) এনেছি। নতুন কারিকুলাম প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে যাচ্ছে। নতুন কারিকুলামের বইতে কোনো ভুল নেই।”
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, নতুন বছরে অনেক শিক্ষার্থী হাতে বই পায়নি। যারা পেয়েছে তারাও পুরো সেট পায়নি।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া ও রোকসানার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এখনো দুটি বই পায়নি।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসমা আক্তার জানান, সব বই এখনো এসে স্কুলে পৌঁছায়নি। বই এলে শিক্ষার্থীদের হাতে তারা পৌঁছে দেবেন।
নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সিয়াম বলে, “অন্যান্য বছর প্রথম দিনই সব বই পেলেও এ বছর এখনো বই পাইনি। আর যে বইগুলো পেয়েছি সেগুলোর পৃষ্ঠা খুব পাতলা।”
শহীদ মনু মিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সংবাদ প্রকাশকে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, “এখনো বাচ্চা বই পায়নি, যারা বই পেয়েছে তাদের দেখে বাচ্চা তো মন খারাপ করে।”
যদিও এনসিটিবির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকের ৮৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৭৮ শতাংশ বই বিতরণ করা হয়েছে।
বইয়ের পৃষ্ঠার মান ও বানান নিয়ে রাজধানীর শহীদ মনু মিয়া উচ্চবিদ্যালেয়ের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের অভিযোগ, “যে বই দিয়েছে সেগুলো কালো কালো ময়লার মতো দেখা যায়। এই বই দুই বছর কীভাবে পড়বে, সেটা নিয়ে বাচ্চারা চিন্তা করছে। তাই আরেক সেট পুরোনো বই আরেকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছি।”
একই বিদ্যালয়ের শিক্ষর্থী আরিফ হোসেন বলে, “সব বই তো পাইনি। আর যেগুলো পেয়েছি কাগজ খুব পাতলা এবং ছাপাও ভালো না।”
এ ছাড়া বানান ভুল, ইংরেজি বইয়ে বাংলায় নির্দেশনা দেওয়ার মতো ভুলও দেখা যায় বইগুলোতে।
এ বিষয়ে উল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, গণমাধ্যমে কথা বলতে হলে নাকি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়।
ঠিক সময়ে বই সবার হাতে বই দিতে না পারার কারণ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “আমরা জানুয়ারির ১ তারিখে বই উৎসব করতে পারব কি না, সেটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, বই ছাপাতে দেরি হয়েছে, একটা সময় বিদ্যুতের সমস্যা ছিল, কাগজের সংকট হলো। তবে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সম্ভব হয়েছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই সবাইকে শতভাগ বই দেওয়া হবে।”
এদিকে কাগজের সরবরাহ সংকটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (১৭ জানুয়ারি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির মুখপাত্র তোফায়েল খান। গত ২ জানুয়ারি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রাক্-প্রাথমিকের শতভাগ বই ছাপানো সম্ভব হলেও এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বই ছাপানোই হয়নি।”
অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজি
নিম্নমানের কাগজ ও বইয়ের উজ্জ্বলতা কমের ব্যাপারে অসংখ্য অভিযোগের করে শিক্ষাথীরা। এ ব্যাপারে জানা যায়, এনসিটিবি ৮৫ শতাংশের জায়গায় ৮২ শতাংশ উজ্জ্বলতা দিতে বললেও ৮০ শতাংশ বা ক্ষেত্রবিশেষে তারও কম উজ্জ্বলতার বই দেয় প্রেসগুলো।
এনসিটিবির সচিব নাজমা আক্তার বলেন, “বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের একটা প্রভাব যেন শিশুদের ওপর না পড়ে সে জন্য সরকার অন্য বাজেট থেকে কাটছাঁট করে বই উৎপাদনে ব্যয় করেছে। কাগজের খরচ কমাতে এবং দ্রুত উৎপাদনে আমরা উজ্জ্বলতা কিছুটা কমিয়েছি। কিন্তু কাগজের মান ঠিক ছিল। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর প্রবণতা হলো যত কম খরচে কাজ চালিয়ে মুনাফা করা যায়। এতে বইয়ের মান পড়লে পড়ুক। এখানে সেটাই হয়েছে।”
বইয়ের ভুলের কারণ
নতুন বই শিক্ষাথীরা পেলেও বইয়ে নানা ধরনের ভুল দেখে তাদের অনেকের আনন্দই ফিকে হয়ে গেছে। বইয়ের ভুল বানান আর গল্পের পুনরাবৃত্তির বিষয়টি বড় ধরনের ভুল বললেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, “প্রথম বছর এই পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে। এখানে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। কিছু সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে।”