ঢাকায় ফেসবুক লাইভে এসে আবু মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ীর নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। উঠে এসেছে নগরজীবনের নিঃসঙ্গতার কথা। তিনি চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর হওয়ায় আলোচনাটা হয়তো একটু বেশি হয়েছে।
অবশ্য এটাই প্রথম নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বলা যায় ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। আর বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। এমনকি বিত্তবানেরাও আত্মহত্যা করছেন। আত্মঘাতী হওয়ার এই প্রবণতা কেন?
চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মহসিন খান (৫৮) লাইভে বলেছেন, “আমার একটা মাত্র ছেলে। সে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। আমার বাসায় আমি সম্পূর্ণ একা থাকি। আমার খালা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে খুব ভয় করছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি, আমার মনে হয় না যে, এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে, আমি মারা গেছি। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী যাদের জন্য যাই কিছু আমরা করি। আমরা সবকিছু করি সন্তান এবং ফ্যামিলির জন্য।”
অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলি এলাকার আফরোজা ছাত্রী হোস্টেলের পরিচালক আফরোজা মীম বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। মাত্র ২১ দিনের নবজাতক সন্তান রেখে জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে জীবন দিলেন তিনি। ঘটনাটি চলতি বছরের ২৩ অক্টোবরের।
ফেসবুক লাইভে মীম নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করে তার নানা চড়াই উতরাই পেরোনোর কথা বলেন। এ সময় তার কাছে কেউ টাকা পাবে না বলে জানিয়ে তিনি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের কারণেই এই পরিণতি বলে জানান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে (সরাসরি সম্প্রচার) কষ্টের কথা জানিয়ে রাজশাহীতে এক গৃহবধূ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। চলতি বছরের ১৮ জুন ভোরে রাজশাহীর চারঘাট পৌর শহরের হলের মোড় এলাকার একটি ভাড়াবাড়িতে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
লাইভে ওই তরুণী স্বামীর উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি সন্তানের বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করবে। আমি তোমাদের দুজনকে খুব ভালোবাসি। তোমার যখন চাকরি ছিল না, বেকার ছিলে, তখন আমি তোমাকে ছেড়ে যাইনি। এখন তোমার চাকরি হয়েছে। যে নতুন জীবনসঙ্গী হবে তাকে সময় দিয়ো।’
চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন মডেল ও অভিনেত্রী তানজিম তাসনিয়া (২৬)। রাজধানীর ধানমন্ডি ৯/১ নম্বর রোডের ৩১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
কুমিল্লায় পছন্দের তরুণকে বিয়ে করতে না পারার অভিমানে একে-অপরকে ভিডিও কলে রেখে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন সদ্য বিবাহিত এক কিশোরী (১৬) ও তার বন্ধু (২২)। মৃত্যুর আগে চিরকুটে তাঁদের একই কবরস্থানে দাফন করার অনুরোধ করে গেছেন তারা।
শনিবার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় কুমিল্লার লালমাই উপজেলার একটি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। রাত ১১টার দিকে বাল্যবিবাহের শিকার ওই কিশোরীর স্বামীর বাড়ি থেকে তার ‘ঝুলন্ত’ লাশ ও চিরকুট উদ্ধার করেছে পুলিশ। অন্যদিকে কিশোরীর প্রবাসী প্রেমিক ওমানে গলায় ফাঁস নিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন। রোববার ঘটনাটি জানাজানি হয়।
শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ঘটছে এমন ঘটনা। মেয়ের নামে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। সেই অপমান সইতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন একই পরিবারের তিনজন। এ ঘটনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের, ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারিতে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যদি এই সময়ে আলোচিত আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে হঠাৎ করে নয়, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ তার মৃত্যুর পর মানুষ কীভাবে ঘরে ঢুকবে তার ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন৷ এটা একাকীত্ব থেকে গভীর বিষন্নতার ফল৷
তিনি বলেন, ‘‘আবার ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার একটি ঘটনা যখন প্রচার পায় তখন অন্যদের প্রভাবিত করে৷ আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে যদি পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয় তাহলে আরেকজন আত্মহত্যার যুক্তি খুঁজে পায়৷ তাই আমাদের সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন৷’’
মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারেন না৷ পৃথিবীতে নগরেই আত্মহত্যা বেশি ঘটে৷ বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে৷ প্রযুক্তি মানুষকে যেমন সচেতন করে তেমনি আত্মহত্যাপ্রবণ করে৷ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার মধ্যে কেউ ‘বীরত্ব’ খুঁজে পেতে পারেন বলে মনে করেন এই মনোচিকিৎসক৷
মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে : ড. নেহাল করিম
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে৷ আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বের চিত্র৷ এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন তখন আত্মঘাতী হন৷ তবে এইসব কারণের মূল উপাদান রাষ্ট্র ও সমাজেই বেশি৷
কিশোর-কিশোরীদের যারা অবহেলা, কটূক্তি, অপরাধ প্রবণতা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তারা আত্মঘাতী এবং আত্মহত্যাপ্রবণ বেশি হয়ে থাকে।