একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। তার বাবা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর আরও তিনজন জাতীয় নেতাসহ তাকে বন্দী করে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তাজউদ্দিন আহমেদকে হত্যা করা হয়। তারই একমাত্র ছেলে সোহেল তাজ অনেক আগ্রহ নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন।
২০০৮ সালে গাজীপুর-কাপাসিয়া থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। কিন্তু বেশিদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেননি। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। মন্ত্রিসভা থেকে ঠিক কী কারণে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি, সেটি এখনো অনেকের কাছে অজানা।
সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে মুখোমুখি হয়েছিলেন সোহেল তাজ। জানিয়েছেন তার পদত্যাগের নেপথ্য কারণ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করায় ক্ষোভে ও অভিমানে পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম না বললেও তখন আলোচনা ছিল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম পুলিশের বদলিসহ সব নিয়ন্ত্রণ করতেন, যা মেনে নিতে পারেননি সোহেল তাজ। শেখ সেলিম তখন সরকারের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না।
সোহেল তাজ এমনই ইঙ্গিত দেন সংবাদমাধ্যম মানবজমিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। তার ভাষায় সরকারের ৯০ ভাগ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত হতো শেখ হাসিনার লোকদের দ্বারা। মন্ত্রণালয়গুলো চলতো ম্যাজিক্যালি।
সোহেল তাজ বলেন, ১৫ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের এখন যে পরিস্থিতি হয়েছে মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সময়ই তা আঁচ করতে পেরেছিলেন।
সোহেল তাজ জানান, তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অথচ তার নির্দেশ পালন করতেন না সচিবরা। তাদেরকে বলা হয়েছিল সোহেল তাজের কথা না শোনার জন্য। তার অজান্তেই এসপি বদলি হয়ে যেত। পরে তিনি বাধ্য হয়েই পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর দৃশ্যপট অন্যদিকে যায়। তাকে জীবন-মরণ লড়াই করতে হয়। বিভিন্নভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়। তার ভাগ্নেকে পর্যন্ত গুম করা হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব পেয়ে ওই বছরের মে মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ওই সময় তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করায় ৭ জুলাই তিনি আবার পদত্যাগপত্র দিলে সেটি গ্রহণ করা হয়।
সোহেল তাজ বলেন, “২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাই। আমি খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে। আমার ইচ্ছা ছিল দেশটাকে একটি সুন্দর, প্রগতিশীল উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। তার মানে আমি এটাও জানি আমাকে কী করতে হবে? সিস্টেমিক চেঞ্জ করতে হবে। সিস্টেমিক চেঞ্জ করতে চেয়েছিলাম আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনীতি ও দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য কাজ করে। আওয়ামী লীগ এরকমই একটা ইশতেহার দিয়েছিল যেটি আমাকে সাংঘাতিকভাবে উৎসাহিত করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল নির্বাচন কমিশন। একদম একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হবে। যেখানে কোনো ভোটের কারচুপি হবে না। আপনার ভোট আমার ভোট স্বদিচ্ছায় দিতে পারবো। এমনই একটা বাংলাদেশ হবে। এরকম একটা চিন্তা নিয়ে আমি মনে-প্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, নতুন একটা বাংলাদেশ বিনির্মাণে।”
তিনি বলেন, “যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চেঞ্জ, মজবুত ও রিফর্ম করতে চাই তাহলে এনসিউর করতে হবে সুশাসন ও গুড গভর্নেন্স। আমরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করবো গুড গভর্নেন্সের মাধ্যমে। সুশাসনের পূর্বশর্ত আইনের শাসন। যে সমাজে জাস্টিস থাকবে না সেখানে আপনি কখনো সুশাসন কায়েম করতে পারবেন না। আপনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান তবে দেখতে হবে আইনগুলো প্রয়োগ করছে কে। হাতিয়ারটা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই রিফর্ম করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আগে ডি পলিটিসাইজ করতে হবে বাহিনীগুলোকে। তাদেরকে একটি পেশাদার, শৃঙ্খলা ও জনগণের বন্ধু বানাতে হবে। আমি সেদিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম।
সোহেল তাজ বলেন, “আমার চিন্তা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে। তাদেরকে সঠিকভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুর্নীতি দূর করতে হবে। দুর্নীতির ক্যান্সার সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি ঠিক করতে না পারলে অনিয়ম ঠিক করা যায় না। করাপশন কলাপস এভরিথিং। করাপশনকে থামাতে হলে লাগবে একটি দক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমি এসব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখি আমি একাই এটা চেয়েছি। একা চাওয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়নি। বরং উল্টো আমাকেই ভিকটিমাইজ করা হত। আমি যখন পদত্যাগ করেছিলাম তখন অনেক মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছে।”
সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা মিটিং ডেকে ছিলাম। আইজিপি, এসবি প্রধান, র্যাব প্রধান, ডিবি প্রধান এবং সকল সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদেরকে স্পষ্ট করে বলেছিলাম বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য এখন থেকে বন্ধ। এখানে কোনো ব্যবসা চলবে না। আমি যতদিন থাকবো ততদিন এটা অ্যালাও করবো না। এটা শুধু পুলিশের মধ্যে না। এই লিংকেজটা অনেক ওপরের দিকে যায়। এখানে অনেক অদৃশ্য শক্তি আছে যারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক ক্ষেত্রে আমার অজান্তেই একটা অদৃশ্য শক্তি কাজ করে নেয়। এসপি বদলি হয়ে যায় অথচ আমি নিজেই জানতাম না। এ ধরনের ঘটনা যখনই ঘটতে লাগল তখন আমি মনে করলাম এখানে একটা পদ নিয়ে বসে থাকার মানে হয় না। আমি বলেছিলাম পুলিশকে রিফর্ম করতে হলে তাদের বেসিক চাহিদাগুলো আমাদের পূরণ করতে হবে। তাদেরকে মধ্যবিত্ত স্ট্যাটাসে রাখতে হবে যাতে তাদের পরিবার স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। তাদের যাতে কোনো চাহিদা না থাকে। পরে আমরা তাদের কাছে ডিমান্ড করবো আপনাদেরকে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। ঘটনা আরও আছে। মন্ত্রণালয়গুলো ম্যাজিকেলি চলতো। ৯০ শতাংশ মন্ত্রী জানেন না তাদের মন্ত্রণালয় কীভাবে চলছে।”
ওপর মহল বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “ওপর মহল হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক কালচারে যা হয়ে এসেছে। যারা দলীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আছেন। এ ছাড়া যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক কালচার হচ্ছে পরিবারতান্ত্রিক। এখানে অনেক পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। যারা কলকাঠি নেড়েছেন। মন্ত্রীরা অনেক ক্ষেত্রে জানতেন না কী হচ্ছে তাদের মন্ত্রণালয়ে। সচিবদের ম্যানেজ করে কন্ট্রোল করা হতো। আমি আমার মন্ত্রণালয়ে অনেক নির্দেশ দিতাম কিন্তু সেগুলো দেখতাম হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম বলা হয়েছে আমার কথা না শোনার জন্য। আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম জনগণকে সার্ভ করার জন্য। এমন হলে কেন থাকব আমি? আমি তো এখানে টাকা বানাবার জন্য আসিনি। তো কেন আমি এই সিটে থাকব।”
পদত্যাগের সুনির্দিষ্ট কি কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “সিরিজ অব ইভেন্টস। একটার পর একটা ঘটনা জমতে জমতে তখন যা হয়। আমি একটা টাইমফ্রেম হাতে রেখেছিলাম আগেই। আমরা যদি সঠিক পথে যাই তার চিহ্ন প্রথম ৬ মাসেই পেয়ে যাবো। আপনি কোন ডিরেকশনে যাবেন সেটার ম্যাপিং করতে হবে না? তাহলেই তো ব্লুপ্রিন্টটা চলে আসবে।”
বলা হচ্ছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এক ব্যক্তির সঙ্গে আপনার ঝামেলা হয়েছিল? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখানে অন্যভাবে জিনিসগুলো এসেছে। কিন্তু আমাকে কেউ মারবে আর সে বাসায় বসে থাকবে, এটা হতে পারে না। আমার গায়ে টাচ্ করলে হাসপাতালে যাবে সে। এখানে মারধরের কোনো বিষয় ছিল না। এখানে বিষয়গুলো ছিল আরও সূক্ষ্ম। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত পড়েছে। কারণ তারা যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে কাজগুলো করতে পারেনি। এজন্যই তারা পদত্যাগের পর মিষ্টি বিতরণ করেছিল।”
কারা মিষ্টি বিতরণ করেছে এবং কারা কলকাঠি নাড়তো? শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “ওনার পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। যাদের কোনো সরকারি পজিশন না থাকা সত্ত্বেও হস্তক্ষেপ করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। বিভিন্ন এজেন্সির উপর তারা প্রভাব বিস্তার করতেন। পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও হস্তক্ষেপ ফিল করেছি। যতটুকু পেরেছি আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছি।”