১৯৭০ সালের মার্চ মাসের কথা। রাওয়ালপিন্ডি কার্ডিয়াক সেন্টারে সম্পন্ন হয় সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি। এ দলে ছিলেন এক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। তিনি অধ্যাপক আব্দুল মালিক। এর জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে জাতীয় পুরস্কারও দিয়েছিল। সে বছরই তাকে মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু বরাবরই অধ্যাপক মালিকের মনে হচ্ছিল, যত চিকিৎসাসুবিধা, যত উন্নতি সব পশ্চিম পাকিস্তানেই হচ্ছে, সব রকম সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ।
প্রেসিডেন্ট হেডকোয়ার্টারে কাজ করা জেনারেল পীরজাদা ছিলেন অধ্যাপক মালিকের রোগী। তাকে বারবার এ কথা বলে একসময় রাজি করিয়ে ফেলেন অধ্যাপক মালিক। তাকে পূর্ব পাকিস্তানে ডেপুটেশনে পাঠাতে রাজি হলো কেন্দ্রীয় সরকার। ঢাকায় ফিরে এলেন অধ্যাপক মালিক। পিজি হাসপাতালে কার্ডিওলজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পর হৃদ্রোগের চিকিৎসার জন্য ছিল পিজি হাসপাতালের ১টি ওয়ার্ড, ১টি সিসিইউ আর ২০টি বেড। সে সময়ে অধ্যাপক আবদুল মালিক ভাবতেন, কীভাবে একটা আলাদা হৃদ্রোগ হাসপাতাল করা যায়। যেখানে চিকিৎসার পাশাপাশি জনশক্তি উন্নয়ন, মানে হৃদ্রোগে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে।
ডা. আবদুল মালিকের এ ভাবনায় কথা জেনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রস্তাবে রাজি হলেন। তবে শুরুতে নতুন দালানকোঠায় বিনিয়োগ না করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পুরোনো ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনে হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
অর্থসাহায্যের জন্য জাপান থেকে একটি প্রতিনিধিদল আসে। তারা জানায়, হৃদ্রোগ ধনীদের রোগ, এর জন্য কোনো সাহায্য দেওয়া যাবে না। অধ্যাপক আবদুল মালিক তখন তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে এটি কেবল ধনীদের রোগ নয়, বাতজ্বরজনিত হৃদ্রোগ গরিব ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার রোগীদেরই হয়। উচ্চ রক্তচাপ গরিব-ধনী যে কারও হতে পারে। তিনি প্রতিনিধিদলকে বলেন, “আপনার পিজিতে আসুন, দেখে যান, এটা গরিবদেরও হয়।”
সত্যি তারা পিজিতে যান। ওয়ার্ডগুলো দেখে টের পান যে হৃদ্রোগে গরিবেরাও আক্রান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দলটি যন্ত্রপাতি দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করে। এ সময়ই পরিসংখ্যান ও গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে পারেন অধ্যাপক মালিক।
১৯৮০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি। হৃদ্রোগ চিকিৎসার মান উন্নয়ন আর হৃদ্রোগ নিয়ে গবেষণাই যার মূল উদ্দেশ্য। গড়ে তুলেছেন ‘ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। এখানে হৃদ্রোগে দক্ষ জনশক্তি, চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা কার্যক্রম চালু আছে। তার উদ্যোগেই জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে এবং পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চালু হয় হৃদ্রোগের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি।
অধ্যাপক আবদুল মালিক কোভিডের সময়টা বাড়িতে বসে থেকে নষ্ট না করে লিখে ফেলেছেন আত্মজীবনী, জীবনের আরও কথা। এটাই একমাত্র নয়, আরও ছয়টি বই লিখেছেন তিনি, যার গ্রন্থস্বত্ব ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও অনুল মালিক ট্রাস্টকে দিয়েছেন।
অধ্যাপক আবদুল মালিকের পথ পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিন শতাধিক হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন দেশের নানা প্রান্তে চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন।