সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিল। এই কাউন্সিল ঘিরে ইতিমধ্যে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, মহানগর কমিটির সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
দলটির জাতীয় কাউন্সিল ঘিরে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আওয়ামী লগের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বেশি।
ঐতিহ্যবাহী দলটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কে আসছেন বা কার কাঁধে উঠছে কঠিন দায়িত্ব, তা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন আলোচনা হচ্ছে, তেমনি বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরেও সরব আলোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের জন্য তাই প্রাসঙ্গিক বাস্তবতায় আসছে ডিসেম্বরের জাতীয় সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নতুন নেতৃত্ব দিয়ে তাদের প্রধান ও প্রথম কাজ হবে, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মাঠ দখলের রাজনীতিকে আশ্রয় দিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করা।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সামনে সাতটি চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলা করা। দুই. বৈশ্বিক শক্তির চাপ সামলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। তিন. জনশ্রেণির আস্থা অর্জনে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। চার. অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি কাউন্সিল বা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলকে পুনর্গঠন করা। পাঁচ নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে রয়েছে, রাজনৈতিক জোটকে পুনরায় গুরুত্ব দিয়ে সমমনাদের মূল্যায়ন করার বিষয়টি। ছয়. প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সেসব আমলাকে শনাক্ত করা, যারা একটি বিশেষ শক্তির স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে বা যেতে পারে। সবশেষ, সুশীল সমাজের নামে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীদের প্রতিহত করা।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের শেষ ভাগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে ২০২৪-এর শুরুতেই নির্বাচনের সম্ভাবনা বেশি বলে আলোচনা হচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “নতুন নেতৃত্ব দিয়েই আগামী দিনের রাজনীতি কোন পথে চলবে, তা নির্ধারণ করা হবে। নতুন নেতৃত্ব দ্বারা আমরা রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করব।”
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, দলের আসন্ন কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি হিসেবে থাকবেন, এটা নিশ্চিত। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে দলটি নতুন নেতার সন্ধান করতে যাচ্ছে।
এদিকে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রতিদিনই গণমাধ্যমের সামনে কথা বলছেন। তবে তার বয়স ও শারীরিক অবস্থা সব মিলিয়ে, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে কতটুকু আর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে দলের ভেতরই আলাপ রয়েছে। অনেকের কাছে এই প্রশ্নও রয়েছে, তিনি এমন গুরুদায়িত্ব নিয়ে সামনের দিনগুলোতেও সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকতে চান কি না?
আওয়ামী লীগের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, দলটির জন্য একজন দক্ষ, সৎ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাধারণ সম্পাদকের দরকার। যিনি মূলত সেনাপতি হয়ে শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনাকে মসৃণ করতে নিজ দলের হয়ে শ্রেষ্ঠ মুখপাত্র হয়ে সব দিক ঠিক রাখবেন এবং সমন্বয় করবেন। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত দুই মাসে নিজের গতি বাড়িয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, তিনি আবার এই দায়িত্বে থাকার মানসে আছেন।
অন্যদিকে এবারের কাউন্সিলে নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে জোর গুঞ্জনই কেবল নয়, অনেক নেতার নামও প্রকাশ্যে চলে আসছে। সেই তালিকায় জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও বাহাউদ্দিন নাছিমের নাম রয়েছে। তবে দলের তিন প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্য থেকে এবার নতুন সাধারণ সম্পাদককে দেখা যাবে বলে আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে। যে তিন নেতার নাম আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে, তারা হলেন: এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, আব্দুর রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। এদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে অন্যদের মধ্যে যাদের নাম উচ্চারিত হচ্ছে তারা হলেন: মাহবুব উল আলম হানিফ, মির্জা আজম, দীপু মনি, হাছান মাহমুদ ও ফজলে নূর তাপস।
আওয়ামী লীগের আসন্ন সম্মেলন নিয়ে বিভিন্ন পদে অনুমাননির্ভর নানাজনের নাম এলেও নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রবীণ-নবীনের সংমিশ্রণে আগামী কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব গঠিত হবে। তবে গতবারের কেন্দ্রীয় কমিটি ও মন্ত্রিসভার মতো এবারও বড় চমক আনতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চমক হিসেবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় আলোচনায় রয়েছেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। দলের ত্যাগী নেতা ওবায়দুল কাদের থেকে যাবেন নাকি তিনি আবার আসবেন এই পদে—এমন আলোচনাও গুরুত্বসহকারে দলটির মধ্যে বেড়েছে।
এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “নির্ধারিত সময় এ বছর ডিসেম্বরে জাতীয় সম্মেলন করতে তৃণমূল পর্যায় থেকে আমরা সম্মেলনের কাজ করছি। সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দল গোছানো, আরও শক্তিশালী করার কাজ চলছে। এই কাজের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্মেলন একটি। এর মধ্য দিয়ে সেসব জায়গায় নেতৃত্বের পরিবর্তন আসছে, জনপ্রিয়, ত্যাগী, সাহসী, নিষ্ঠাবানরাই নেতৃত্বে আসছেন। সম্মেলনের মাধ্যমে সর্বস্তরেই নতুন নেতৃত্ব আসে, এটাই স্বাভাবিক। তবে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন হবে কি না বা কে আসবেন, সেটা নেত্রীর (শেখ হাসিনা) মতামতের ভিত্তিতে কাউন্সিলেই ঠিক হবে। নাম আলোচনায় আসবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত তো হয় কাউন্সিলে।”
সাধারণ সম্পাদক পদে তিনিসহ যাদের নাম আলোচনায় আসছে, সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, “গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা বলে দলের প্রধান (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। অতীত থেকে সেটা হয়ে আসছে। নাম আলোচনায় আসতেই পারে, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।”
এ প্রসঙ্গে দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলির সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলছেন, “নির্বাচনের হাওয়া শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যেই। রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নেবে। এ ক্ষেত্রে সরকার পরিচালনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ওপর দায়িত্ব অনেক বেশি। আশা করি দলের সভাপতি যোগ্য ও পরীক্ষিতজনকেই এবার সাধারণ সম্পাদক করবেন।”
একই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, “আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আওয়ামী লীগ সব সময় বদ্ধপরিকর। দলের সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে যোগ্য মনে করবেন, তাকে সাধারণ সম্পাদক করবেন। তিনি অনেক হিসাব-নিকাশ মাথায় রেখেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। কেননা, তার সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।”