ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান জনসম্মুখে আসছেন না। তার বিভিন্ন বাসভবনে গিয়ে খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে গোপনে দেশে ছেড়েছেন তিনি। যদিও এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কোরবানির ঈদের আগে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনা নিয়ে আলোচনায় আসেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ। পরবর্তীকালে জানা যায়, তিনি রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমানের ছেলে। রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলের এত টাকায় ছাগল কেনা নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গণমাধ্যমেও উঠে আসে মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের কথা।
এর মধ্যে একটি বেসরকারি গণমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিয়ে মতিউর রহমান দাবি করেন, আলোচিত ইফাত তার সন্তান নন। এমনকি তিনি ওই তরুণকে চেনেনও না। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, ইফাত নামের ওই তরুণ মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। বিষয়টি একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এমনকি ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী নিজাম উদ্দিন হাজারীর মামাতো বোন।
ছেলেকে অস্বীকার করেয় নতুন করে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন মতিউর রহমান। এর মধ্যে গণমাধ্যমে আসতে থাকে তার একের পর এক সম্পদের হদিস। শুধু তাই নয়, মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তানদের নামেও প্রচুর সম্পদ রয়েছে বলে উঠে আসে।
এমন আলোচনা সমালোচনার মধ্যে গা ঢাকা দেন মতিউর রহমান। ঈদের পরে আর অফিসেও যোগ দেননি তিনি। এর মধ্যে মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে কালের কণ্ঠ জানিয়েছে, গোপনে দেশে ছেড়েছেন মতিউর রহমান। গণমাধ্যমটি আরও জানায়, রোববার (২৩ জুন) বিকেলের দিকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন তিনি।
এদিকে সোমবার মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।
দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের টিম গঠন
মতিউরের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এজন্য সংস্থাটির উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিমও গঠন করা হয়েছে। রোববার দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ গত ৪ জুন কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এর আগেও গত দুই যুগে চারবার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান করেছে দুদক। প্রতিবারই তিনি দুদক থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি দুদক। এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব বলেন, চারটি পুরোনো অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছিল। তবে এখন নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা পুরোনো কী কী অভিযোগে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন—সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখবেন।
হারিয়েছেন এনবিআরের পদ
ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
জানা গেছে, মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তার। এছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবে। সেই সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য এনবিআর ও দুদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থা দুটি।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে ছিলেন মতিউর রহমান। তবে ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোববার পর্ষদ সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, “পরিচালক সরকারি পোস্ট। অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি ইস্যু না করলে চূড়ান্ত অপসারণ হবে না। তবে মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে, তাকে সরানো হবে। আমাদের সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অপসারণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি ইস্যুর পর। তবে এখন থেকে মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের কোনো সভায় থাকতে পারবেন না।”