সুমন ইসলাম। পেশায় ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রাজধানীর উত্তরার বাউনিয়া বটতলায়। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ছোট্ট শিশুকে নিয়ে সুমনের স্ত্রী সম্প্রতি বরিশাল থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার দুই দিনের মধ্যেই বাসায় হাজির তৃতীয় লিঙ্গের একটি দল। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের জন্য প্রথমে তারা দাবি করেন পাঁচ হাজার টাকা। এই পাঁচ হাজার টাকা দিতে সুমনের স্ত্রী অপারগতা প্রকাশ করলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ উচ্চারণ করে হইচই শুরু করেন তারা।
সুমন অফিসে থাকার সুবাদে বাসায় তার স্ত্রীকে একা পেয়ে টাকা দিতে চাপ প্রয়োগসহ অপমানও করেন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা। পরবর্তীতে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে সুমনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ২ হাজার ৫০০ টাকায় তাদের রাজি করাতে সক্ষম হন। এরপর এই টাকা নিয়ে বাসা থেকে চলে যান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেন যে, টাকা ছাড়া কোনোভাবেই তারা এক পা নড়তে চান না। বারবার শুধু তারা বলতে থাকেন টাকা দে, টাকা এনে দে। শেষমেষ এক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে বাসার সবাইকে অপমান করেন।”
তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের এমন অপমানের শিকার শুধু সুমনের স্ত্রী একাই নন। তাদের এমন ঘটনা এখন রাজধানীতে প্রতিদিনের চিত্র। কোনো বাসায় সন্তান জন্ম নিলে উল্কার বেগে হাজির হন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা। বিয়েবাড়িতেও উৎপাত করে চাঁদার জন্য। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ উচ্চারণ করে, হইচই, গালিগালাজ করে। রাজধানীবাসী তাদের কাছে অসহায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে নগরীর পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
শুধু চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ নয় তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা। পাশাপাশি মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এমনকি তাদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও পাত্তা দেন না তারা।
এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহযোগিতার নামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সাধারণ মানুষের কাছে থেকে যে প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় করছেন, এটি আসলে কেউ পছন্দ করছেন না। পাশাপাশি তাদের এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ব্যবস্থা থাকা দরকার তারাও জোর করে সেই ব্যবস্থাকে প্রয়োগ করতে পারছেন না। কারণ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। তাই তাদের জীবনযাপন বা জীবনাচারণকে পুঁজি করে অপরাধ এবং সমাজের মধ্যে সাধারণ মানুষদের গমনাগমনে হয়রানি করে অর্থ আদায় করা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কঠোর বা দৃষ্টান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। অন্যথায় এটা বাড়তেই থাকবে।”
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের উৎসবগুলোর সঙ্গে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ যে জনগোষ্ঠী রয়েছে তারা তাদের বৈশিষ্ট্যকে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষের কাছে যে প্রক্রিয়ার সহযোগিতা আদায় করেন, সেটিকে আমরা চাঁদাবাজির সঙ্গে তুলনা করি। এই বিষয়টি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সহযোগিতা হিসেবে মনে করেন। বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কেউ থাকলে মানুষ সহজাত, সহানুভূতির জায়গা থেকে তাদের সহযোগিতা করে থাকেন। তবে এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার বাইরে থেকে বা ঢাকার মধ্যে অনেকেই বেশ ধারণ করে এই কাজগুলো করছেন।”
তৌহিদুল হক আরও বলেন, “আমাদের উন্নয়নের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা, তাদের যুক্ত করার জন্য পুনর্বাসন বা আর্থিক যে পুনর্বাসন অর্থের উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকারের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু আমাদের এই কর্মসূচিগুলো খুব একটা বেশি সফল হয়নি। তার কারণ হলো, যখন কোনো একটা বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ নাগরিক কর্মবিহীন মানুষের কাছে তার অবস্থান বোঝানো বা কখনো জোর করে দৈনিক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে, তখন তাদের আর্থিক পুনর্বাসন বা কর্মের সাথে সম্পৃক্ত করে স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সরকার বা রাষ্ট্রের যে উদ্দেশ্য অনেক সময় সেটি পূরণ হয় না। তাই কোনো ধরনের সহযোগিতা পরিহার করে প্রতিটা বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ মানুষদের জন্য আর্থিক পুনর্বাসন এবং তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থাকেও যদি সার্বিকভাবে করা যায়; তাহলে এই অবস্থাগুলো কমে আসবে। তবে যারা তৃতীয় লিঙ্গের বেশ ধরে টাকা আদায় করছেন তাদের শনাক্ত করে অভিযান পরিচালনা করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।”
তথ্য বলছে, তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে সবাই যে প্রকৃত তা নয়। অনেক প্রতারক পুরুষ হয়েও মুখে মেকআপ দিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য সেজে রাস্তা, বাস ও দোকান থেকে টাকা ওঠায়। এদের মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার করলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বের হয়ে তারা আবারও এমন পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে মামলা রয়েছে। তবে রাজধানীসহ সারা দেশে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদেরদের সংখ্যা ২০২৩ সালের সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক তথ্যমতে, ২০ হাজার এবং রাজধানীতে প্রায় ২ হাজার বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার।
সরেজমিনে রাজধানীর বাড্ডা, শুলশান, বনানী, উত্তরা, মহাখালী, পরীবাগসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ট্রাফিক মোড়গুলোতে সিগন্যাল পড়লেই দল বেঁধে গাড়ি থেকে টাকা আদায় করেন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা। কেউ টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও তাদের অকথ্য ভাষায় গালিও দেন তারা। আশেপাশে সড়কে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্বে থাকলেও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের দৌরাত্ম্যে তারাও যেন অসহায়। আবারও শিক্ষার্থীরা টাকা দিতে রাজি না হলেও তাদের হাতে মার খেতে হয়।
মহাখালী থেকে বিআরটিসির দোতালা বাসে উঠা হালিম নামের এক ভুক্তভোগী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “কিছুক্ষণ আগে একটি বাসে উঠেছিলাম। দুইজন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য এসে আমার কাছে থেকে ৫০ টাকা নিয়ে গেছে। আমি ১০ টাকা দিলে তারা নেয়নি। তারা আমার কাছে ১০০ টাকা দাবি করেন। পরে জোর করে আমার কাছে থেকে ৫০ টাকা নিয়ে গেছে।”
হালিম আরও বলেন, “তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা এতটাই খারাপ যে টাকা না দিলে বিভিন্ন খারাপ ভাষায় কথা বলে। আবার কাপড়ও তোলে অনেক সময়। বাসে থাকা লোকজনের সামনে অপমানের ভয়ে অনেক সময় আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই টাকা দিতে হয়।”
জানা গেছে, রাজধানীতে প্রতিটা গুরু মার অধীনে কয়েক হাজার তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা বসবাস করেন। তারা মূলত তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের নেতৃত্ব দিয়ে চাঁদার টাকা আদায় করে থাকেন। তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা ঢাকার সড়ক থেকে যে টাকা আদায় করেন তার বেশিরভাগ অংশই গুরুমাদের পকেটে চলে যায়। যে যৎসামান্য টাকা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা পান তা দিয়ে তাদের পেট চালাতেই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। তবে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের সড়ক থেকে তোলায় চাঁদায় গুরু মারা গড়ে তুলেছেন গাড়ি, বাড়ি। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসাও রয়েছে তাদের।
তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের এমন চাঁদাবাজি বন্ধে সরব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। সম্প্রতি শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় একটি ঘটনায় তৃতীয় লিঙ্গের একজনের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন সময় পুলিশের পক্ষ থেকে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা গেলেও খুব বেশি একটা সুফল পান না সাধারণ মানুষ।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, “তৃতীয় লিঙ্গের কেউ যদি বাসা-বাড়িতে, সড়কে ও যানবাহনে চাঁদাবাজি করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, “সম্প্রতি শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় একটি ঘটনায় তৃতীয় লিঙ্গের একজনের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তৃতীয় লিঙ্গের বিভিন্ন সদস্যের নামে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব অভিযোগের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”