কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। দেশের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ বিদায় জানিয়ে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং তার আত্মার শান্তি কামনা করেন। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনীতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা।
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নেতারা কথা বলেন। এর আগে বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে সকাল সাড়ে ১০টায় তার কফিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আনা হয়। এরপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই মুক্তি সংগ্রামের এই বীরকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শুরু করেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, “ডা. জাফরুল্লাহ শুধু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাই নয়; বরং একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের চিকিৎসক। দেশের চিকিৎসা খাতের উন্নয়নে তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন সাহসী বীর যোদ্ধার পাশাপাশি একজন খাঁটি বাঙালিও ছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে আমরা চিকিৎসা সেবার যে আমূল পরিবর্তন দেখছি তার পথিকৃৎ তিনি। আমি তাকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তার পরিবার এবং ভাইবোনদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। এই সুবাদে তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। ছোট ভাইয়ের মতো ডাকতেন। তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। জাতির এই বীর সন্তানকে নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই আছে। দেশকে প্রকৃত বাংলাদেশে রূপান্তর করা, আইনানুগ গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক দেশ সৃষ্টি করা, যেখানে সকল মানুষ সমান মর্যাদা পাবে এবং অধিকার ভোগ করবে। সেই যুদ্ধে ডা. জাফরুল্লাহ একজন সামনের সারির যোদ্ধা ছিলেন। তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসাধারণ সাহসী, সৎ, দেশপ্রেমিক, নির্ভীক এবং স্পষ্টবাদী ছিলেন। তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, স্যালুট জানাচ্ছি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, ওষুধ -সবকিছুই ছিল তার বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। তিনি স্বাস্থ্যনীতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি পারেননি। ওটা করতে পারলে বাংলাদেশের সব মানুষই স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারতেন।”
তিনি বলেন, “দেশ ও মানুষের জন্য কথা বলতেন ডা. জাফরুল্লাহ। কখনো পিছপা হতেন না। এ রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে একটি জনগণের রাষ্ট্র, একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, সাধারণ মানুষের একটি সমাজ নির্মাণ করার জন্য সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন। আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে, বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলাম। তার চলে যাওয়া আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি এবং যে স্থান শূন্য হলো সেটি আর কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, স্যালুট জানাচ্ছি।”
ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আব্দুর রব বলেন, “ডা. জাফরুল্লাহর প্রতি আমাদের ঋণ অপরিসীম। তার ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। তার প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। বাংলাদেশে আরেকটি জাফরুল্লাহ তৈরি হবে না।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “জাফরুল্লাহর অনুপস্থিতি বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে। কিন্তু তার কাজ ও বহুমাত্রিক কীর্তি আমাদের ও অনাগত প্রজন্মকে বহুকাল ধরে অনুপ্রাণিত করবে। মানুষের স্বার্থে একটি পরিবর্তন কীভাবে আনা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতেন জাফরুল্লাহ। তিনি সর্বদা মানুষের কল্যাণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে ভাবতেন। এসব পরিবর্তনের বিষয়ে যারাই ভাববেন নিশ্চিতভাবে সেখানেই ডা. জাফরুল্লাহ প্রাসঙ্গিক থাকবেন। আমরা যত দ্রুত তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারব, তত দ্রুত আমরা এগিয়ে যেতে পারব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “ডা. জাফরুল্লাহ আমাদের চেয়ে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন, অসুস্থ ছিলেন। তারপরও তিনি অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তার অবস্থা দেখে আমাদের ইতস্তত লাগতো, লজ্জা লাগতো। ভাবতাম যে, যদি তিনি অসুস্থ অবস্থায় এমন প্রতিবাদী থাকতে পারেন, তাহলে আমরা কেন সত্য-ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারব না। জাফরুল্লাহ চৌধুরী দলমত নির্বিশেষে সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু তিনি যখন জীবিত ছিলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে অনেক কথা বলছে। আজ তিনি মারা যাওয়ার পর সবাই শোক জানাচ্ছে, ভালোবাসা জানাচ্ছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, যারা নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে মানুষের জন্য কথা বলে, কাজ করে; তারা সবার ভালোবাসা পায়। এ ভালোবাসা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।”