বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের আগ্রহ এখন তুঙ্গে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি।
এই সময়ে কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছে একটি মোড়ল দেশ। এর মূল কারণ দেশটির প্রতি গভীর আনুগত্যে আবদ্ধ থাকা। সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের কৌশল। তবে এসবে মাথা না হেলিয়ে নিজস্ব গতিতে চলছে সরকার।
বিপরীতে, বিএনপি মাঠের রাজনীতি থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের ভালো ফল তুলতে না পেরে বিদেশি চাপকেই এখন ভরসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। যদিও আওয়ামী লীগ এ বিষয়টিকে আমলেই নিচ্ছে না, এর নেপথ্যেও রয়েছে অপর পরাশক্তিদের শক্তিশালী সমর্থন।
তা ছাড়া রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় কয়েক গুণ এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া পাঁচ সিটির নির্বাচনে ভোটের মাঠ দখলে রাখার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সম-অধিকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলটির সরকার বেশ নমনীয় হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি আর বিশৃঙ্খলা দমনে সিদ্ধহস্ত।
যে কারণেই প্রতিপক্ষরা কোনোভাবেই আন্দোলন-সংগ্রাম জমাতে পারছে না। নিতে পারছে না রাজনৈতিক সুবিধা।
এসব কারণেই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন থেকে সরে এসে কূটনৈতিক তৎপরতায় জোর দিচ্ছে বিএনপি। এসব মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় আছে আরও পাঁচ মাসের বেশি। সবকিছু ঠিক থাকলে সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করবে ইলেকশন কমিশন (ইসি)।
তবে এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় রয়েছে বিএনপি। সভা-সমাবেশে বারবার সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের কথা বললেও এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি দলটির নীতিনির্ধারকরা।
এ জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক বিএনপি কর্মীই হতাশায় ভুগছেন। অন্যদিকে এক দফার আন্দোলনে না গিয়ে এ মুহূর্তে বিদেশি চাপকেই বেশি কাজে লাগাতে চায় বলে জানিয়েছে দলটির একাধিক সূত্র।
গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিকেন বাংলাদেশে তাদের নতুন ভিসা নীতি প্রকাশ করে একটি সতর্কবার্তা দেন। সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে জানায় দেশটি।
এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু হয় হইচই। সরকারবিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে কয়েক দিন আনন্দের জোয়ারে গা ভাসান, এ নিয়ে উল্টো ক্ষেপে যায় আওয়ামী লীগ।
এরপর আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করে। তবে সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া কয়েকটি সিটি নির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
আবার বিএনপির কূটনৈতিক চেষ্টায় এবং পুরোনো সখ্যতায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশ আলোচনা সামনে নিয়ে আসে। পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ আনে বিএনপি। এসব কারণ সামনে রেখে কয়েকটি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এতে প্রথম দিকে কিছুটা নমনীয় হলেও পরবর্তী সময়ে নিজ অবস্থানেই অটল থাকে সরকার। বিএনপি মনে করছে এই মুহূর্তে আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহায়তাও প্রয়োজন তাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শাসন-শোষণে পৃথিবী আজও দুই ভাগে বিভক্ত। দুটি শক্তিই আমাদের দেশের দুটি দলকে নেপথ্যে থেকে ফায়দা নিতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে উৎসাহ বাড়াচ্ছে।
আসলে জনগণের শক্তি, কূটনৈতিক কৌশল আর রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতায় যে দল এগিয়ে থাকবে, সে দলই টিকবে।
জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র (পূর্ব) সচিব সৌরভ কুমার। তার এই সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা।
আবার আগামী সপ্তাহে মার্কিন পরররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া এবং দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করবেন।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের এ দুজন কর্মকর্তা ঢাকা সফরে এসে নির্বাচন নিয়েই আলোচনা করবেন প্রধান দুটি দলের সঙ্গে।
রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান রাখতে প্রতিদিন কোনো না কোনো দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন।
একই সঙ্গে বসে নেই আওয়ামী লীগও। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলটির বিশাল টিম কাজ করছে কয়েকটি মিত্রশক্তিকে সঙ্গে নিয়ে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ গত ১৫ দিন ধরে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
তাদের এই সফর শেষে বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির কয়েকটি সূত্র।
আবার বিএনপির অধিকাংশ নেতাই মনে করছেন এ মুহুর্তে চূড়ান্ত আন্দোলনে গেলে সরকারই তাদের হামলা-সংঘর্ষের নামে মামলায় জড়িয়ে ফাঁদে ফেলতে পারে। বিএনপি সেই সুযোগ দেবে না। তাই এখনই আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণা আসছে না।
বিএনপির একটি সূত্র সংবাদ প্রকাশকে জানায়, বর্তমান নানা বিষয়ে রাজনৈতিক সমাধানে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কমনওয়েলথে চিঠি দেবে বিএনপি। সেই চিঠিতে দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সুরক্ষায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হবে।
একই সঙ্গে বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন, সভা-সমাবেশে বাধা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হামলা-মামলার তথ্য-উপাত্ত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হবে ওই চিঠিতে। চিঠিতে স্বাক্ষর করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, “আমরা আন্দোলনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। রাজপথে তৎপরতা না থাকলে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় না।”
অপর দিকে, আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে চলতি মাসেই মাঠে নামার কথা বিএনপির।
তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে বাধা দেবে না আওয়ামী লীগ। তবে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
বিএনপিসহ ৩২ দলের এক দফা আন্দোলন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৩২ দলের এই জগাখিচুড়ির ঐক্য এক দফার আন্দোলনে এসে পতন ঘটবে।
যে লক্ষ্য নিয়ে এই ঐক্য তাতে ফল আসবে অসহনীয়। শনিবার (৮ জুলাই) সকালে কাওলায় এক্সপ্রেসওয়ে পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিনিধিদল আসছেন নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে নয়, রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি জানতে। আর ইইউ প্রতিনিধিদল আসছে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবে তা দেখতে।
আওয়ামী লীগের অপর শীর্ষ নেতারা জানান, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি আরও ষড়যন্ত্র করছে। তারা চায় দেশে অনির্বাচিত সরকার আসুক। ক্ষমতার জন্য বিএনপি দেশের বিরোধিতা করছে। বিদেশিদের কাছে দেশের সুনাম নষ্ট করছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা আরও বলছেন, কোনো বিদেশিদের কথায় এ দেশে সরকার নির্বাচিত করার পথ বন্ধ। কারও কাছে মাথা নত নয়, দেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “আওয়ামী লীগের হাত ধরেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে বলেই বিএনপির আন্দোলনে বাধা দেয় না। বিএনপি তো কত কিছুই বলে, বাস্তবে তা ফলে না। আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করলে জনগণের জানমাল রক্ষায় আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।”
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, বিএনপি একটা সন্ত্রাসী দল, তাদের আন্দোলনের কথা শুনলে দেশের মানুষ ভয় পায়। আন্দোলনের নামে ২০১৪ সালে অসংখ্য মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে তারা। দেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, এ জন্য তারা বিদেশিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। বিএনপির আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই।