আজিজ মোহাম্মদ ভাই। নামটি শুনলেই মনে হবে, কোনো এক ‘গডফাদার’। সাধারণত মাফিয়া ডন বা গডফাদারদের ‘ভাই’ ডেকে থাকেন তাদের অনুগতরা। কিন্তু আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নামে ‘ভাই’ শব্দটি মূলত তাদের বংশপদবী। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ভাই ও মায়ের নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই ‘গডফাদার’ না হলেও তাকে নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। এসব গল্পের বেশিরভাগই চলচ্চিত্র জগতের নারী ও হত্যাকেন্দ্রিক। এসব গল্পের কতটুকু সত্য আর কতটুকু মুখরোচক মিথ্যা সে নিয়েও আছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
১৯৬২ সালে ঢাকার আরমানিটোলায় আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয়। পারিবারিক সূত্রে তিনি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ব্যবসার মাধ্যমেই তার অর্থ সম্পদ বাড়তে থাকে। অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এছাড়াও মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার হোটেল ও রিসোর্ট ব্যাবসা। আবার মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তিনি সার্ক চেম্বারের আজীবন সদস্য। কথিত আছে, ভারতের পলাতক ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
৯০-এর দশকে ব্যবসার পাশাপাশি এমবি ফিল্মসের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। গুঞ্জন আছে, চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে নায়িকাদের রূপের মোহে নাকি কালো টাকা সাদা করতেন। মিডিয়ার মনোযোগ কাড়তে প্রযোজনায় আসেন। চলচ্চিত্রপাড়ায় এসেই নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেললেন তিনি। পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মিডিয়া মালিক ও সাংবাদিকরা তাকে সমীহ করে চলতেন। ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। দেশের বিজ্ঞাপন জগতে গ্ল্যামার আনতেও তার ভূমিকা ছিল। নিজের প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ব্যাটারির ‘আলো আলো বেশি আলো’ বিজ্ঞাপনে মিতা নূরের ঝলমলে উপস্থিতি তখন বেশ নজর কেড়েছিল।
এক নারী নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এরশাদের আমলে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। ওই সময় চলচ্চিত্র নায়িকাসহ বিভিন্ন নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প ছড়াতে থাকে। তবে তিনি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন ১৯৯৭ সালে। সেসময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটাকে আত্মহত্যা বলেই প্রচার করা হয়। যদিও সালমান শাহের পরিবার ও তার ভক্তদের ধারণা এটা হত্যাকাণ্ড। পারিপার্শ্বিক আলামতেও এটাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই মনে হয়। যদিও হত্যাকাণ্ডের সময় থাইল্যান্ডে ছিলেন আজিজ। সালমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুইবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় আজিজকে। কিন্তু কোনো প্রমাণ না পাওয়া পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর দুই বছর পর ঢাকা ক্লাবে খুন করা হয় আরেক চিত্র নায়ক সোহেল চৌধুরীকে। এ হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
ওই সকল ঘটনার পর আজিজ মোহাম্মদ ভাই দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, মিডিয়াই তাকে ‘ডন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে বারবার।
বর্তমানে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সপরিবারে থাইল্যান্ডে থাকেন। সেখান থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পার্টিতে, ক্লাবে নারীদের সঙ্গে ফূর্তিরত অবস্থায় দেখা যায় তাকে। তার স্ত্রী নওরিন মোহাম্মদ ভাই দেশে এসে ব্যবসা দেখেন। পরিবারে আর আছে ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনের যাবজ্জীবন আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী এ রায় ঘোষণা করেন।
কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া বাকি ৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ ছাড়া অন্য দুই আসামি হলেন, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আদনান সিদ্দিকী।