কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে নিহতের ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের সরকার এক সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা এবং নিহতের ঘটনা তদন্ত করবে এই কমিশন।
এ ধরনের তদন্ত কমিশন কেন ও কখন গঠন করা হয়? কেন এই কমিশনকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন বলা হচ্ছে? এই কমিশনের করা তদন্তের সঙ্গে অন্য তদন্তের আসলে পাথর্ক্য কতটুকু? কোন কোন ঘটনার তদন্ত করবে কমিশন?
গত ১৮ই জুলাই সরকারের দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করা হলো।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান এ কমিশনের একমাত্র সদস্য। ‘দ্যা কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ এই আইনের তিন ধারা অনুযায়ী কমিশনটি গঠন করা হয়েছে।
তবে, এই আইনে ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত’ বলে কোনো বিষয় নেই বলে উল্লেখ করেন আইনজীবীরা। যদিও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরাফাত গণমাধ্যমে এই কমিশনকে বিচার বিভাগীয় কমিশন বলে উল্লেখ করেছেন।
একই সঙ্গে একজন বিচারপতি এ তদন্ত কমিশনের সদস্য হওয়ায় সাধারণ মানুষও এটিকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন বলে মনে করছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “একজন বিচারপতিকে এ কমিশনের সদস্য করায় এটিকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত বলে কোন-কিছুর আসলে অস্তিত্ব নেই। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।”
বিচারক ছাড়াও যে কোনো ব্যক্তিকে এ কমিশনের সদস্য করা যাবে। কারণ আইনটিতে কাদের সদস্য করা যাবে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
এ ধরনের কমিশন কখন করা হয়?
এ আইনের তিন ধারাতেই সরকার কখন এ ধরনের কমিশন গঠন করতে পারবে তা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার যদি মনে করে তাহলে গেজেট করে জন-গুরুত্বপূর্ণ সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তদন্ত করার জন্য কমিশন নিয়োগ করতে পারে।
প্রজ্ঞাপনে কমিশনের কার্যাবলী এবং সময় উল্লেখ করে দিতে হবে। গঠিত কমিশন ওই সময়ের মধ্যে কার্যাবলী শেষ করতে হবে।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “দুদক, পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর যে তদন্ত করে সেটির সঙ্গে এ ধরনের তদন্ত কমিশনের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কারণ জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে সরকার এ আইনটি অনুযায়ী তদন্ত কমিশন গঠন করে।”
শাহদীন মালিক আরও বলেন, “কোনো ফৌজদারি অপরাধে তদন্ত করা এ ধরনের কমিশনের উদ্দেশ্য নয় বরং রাষ্ট্রীয় জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা তদন্ত করবে। রাষ্ট্র একজন বা কয়েকজন ব্যক্তিকে দিয়ে তদন্তের উদ্দেশ্যে এ ধরনের কমিশন গঠন করে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কাজ না হয় সেজন্য তাদের কাছে সুপারিশ চায় সরকার।”
অন্য তদন্তের সঙ্গে পার্থক্য কী?
এ কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো তদন্ত করতে পারে না। যথাযথ আইনানুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা সংস্থাগুলোই শুধুমাত্র ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করতে পারবে।
অর্থাৎ তারা শুধু সরকারকে সুপারিশ করতে পারবে। অন্যান্য তদন্ত কমিটির সঙ্গে এ তদন্ত কমিশনের পার্থক্য এখানেই বলে মনে করেন অ্যাড. মালিক।
একই সঙ্গে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতের কিছু সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা এ কমিশনকে আইনানুযায়ী দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ এ কমিশন সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে সমন দিলে তাকে উপস্থিত হতে হবে। এক্ষেত্রে সাক্ষী দিতে না গেলে তখন এ কমিশন ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট কোনো নথি চাইলে তা দিতে হবে।
কোন ঘটনার তদন্ত করবে?
গত কয়েক দিন সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে যেসব নিহত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সবগুলোরই তদন্ত করবে এই কমিশন।
আসলেই কি তাই?
এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে কমিশনের কার্যাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত ১৬ই জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনায় ছয়জন নিহতের ঘটনা তদন্ত করবে এ কমিশন। একই সঙ্গে নিহত ছয় ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ উদঘাটন ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে কমিশন।
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনাও তদন্ত করবে এ কমিশন। এসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণে কাজ করবে এ কমিশন। একই সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এক মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে কমিশনকে।
এরই মধ্যে বুধবার (২৪ জুলাই) কমিশন প্রথম বৈঠক করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত ১৬ই জুলাইয়ের সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে সর্বসাধারণের কাছে তথ্য চাওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিচারপতি খোন্দকার দীলিরুজ্জামানের কমিশন।
কমিশন কোন সময়ের ঘটনার তদন্ত করবে সে বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমে বলেন, “ওই ছয়জনের বিষয়ে এ কমিশন গঠিত হয়েছে, এটার তদন্ত করবে। পরবর্তী ঘটনার বিষয়ে পরবর্তীতে দেখা হবে। আমি আমার এখতিয়ারের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে।”
বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনটি গত ১৬ই জুলাই থেকেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সংঘাতে রূপ নেয়। সহিংসতায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত দেড়শ`র বেশি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। সূত্র : বিবিসি বাংলা