• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্যাংকে গ্রাহকদের আস্থার সংকট তৈরির কারণ কী


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: মে ২০, ২০২৪, ০৯:৫৬ পিএম
ব্যাংকে গ্রাহকদের আস্থার সংকট তৈরির কারণ কী
একটি ব্যাংকের ভেতরের চিত্র। ছবি : সংগৃহীত

ফরিদ আহমেদ নয়ন। পেশায় তিনি একজন চাকরিজীবী। গত বছরের ২০ আগস্ট ইউনিয়ন ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট চালু করেন। খুব ইচ্ছে ছিল, ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘদিন লেনদেন চালু রাখবেন। তবে বর্তমান ব্যাংকিং খাতে নানা সমস্যায় সেই আগ্রহ কমে গেছে। ইউনিয়ন ব্যাংকে তার জমানো যে টাকা ছিল, তা তিনি উত্তোলন করেছেন এবং অবশিষ্ট ৫৩ টাকা রেখেছেন। ভবিষ্যতে এই টাকা ভ্যাট ক্ষেত্রে কেটে নিয়ে গেলে আফসোস নেই তার।

নয়ন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঋণ অনিয়ম ও নানা জালিয়াতির কারণে ব্যাংকের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। যেভাবে ব্যাংকগুলো ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে, তাতে মনে হয় স্বাভাবিক হতে অনেক বেশি সময় লাগবে। ভালো ভালো ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে ভুগছে। নিজেদের সঞ্চয়ের টাকা দিতে পারছে না। তাহলে মানুষ কোন ভরসায় টাকা রাখবে। ব্যাংকে আমার যা টাকা ছিল, তা আমি উত্তোলন করেছি। এখন যা টাকা আছে তা গেলেও আমার আফসোস নেই।”

ফরিদ আহমেদ নয়নের মতো আরও অনেক গ্রাহক আছেন, যারা ব্যাংকে টাকা রাখা, না রাখা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। এছাড়াও অনেক সঞ্চয়কারী ব্যাংক একীভূত হলে টাকা পাবেন না, এমন শঙ্কায় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাদেরই একজন আরাফাত ইসলাম।

আরাফাত ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি। কিছু টাকা ব্যাংকে রেখেছিলাম। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় সেই টাকা উত্তোলন করতে বাধ্য হচ্ছি। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের মুখে এবং গণমাধ্যমে যে বার্তা পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকেই নাকি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছে। তাই আমিও টাকা উত্তোলনের সিদ্বান্ত নিয়েছি। টাকা রেখে দিলে পরবর্তীতে তুলতে পারব কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছি।”

আরাফাত ইসলাম আরও বলেন, “মানুষের সঞ্চয় রাখার একমাত্র ভরসা ব্যাংক। শুনলাম অনেক ব্যাংকে নাকি টাকা নেই। মানুষ টাকা তুলতে পারছেন না। নিজের টাকা ব্যাংকে রেখে ভরসা নেই। দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাংক হারিয়ে যাওয়ার পথে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে মানুষের ভরসা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও কমতে শুরু করেছে।”

কাউসার নামের আরেকজন গ্রাহক বলেন, “ন্যাশনাল ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। তাই গ্রাহকরা এসব ব্যাংকে টাকা উত্তোলন করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তাই মানুষ কোনোকিছু না ভেবেই বেশি বেশি টাকা উত্তোলন করা শুরু করেছেন। আমিও ব্যাংক থেকে অর্ধেক টাকা তোলার সিদ্বান্ত নিয়েছি। পরবর্তীতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরে এলে, তখন আবার টাকা রেখে দেওয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছি।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে সবলের একীভূতকে কেন্দ্র করে পুরো ব্যাংক খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দিন দিন মানুষ ব্যাংকের টাকা হাতে নিতে শুরু করেছে। এছাড়াও নানা অনিয়মের মাধ্যমে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, নানা অব্যবস্থাপনা, দখল, কেলেঙ্কারি আর লুটপাটের খবর আসছে প্রতিদিনই। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে কমে গেছে আমানত। তবে, আমানত কমলেও বেড়েছে ঋণের পরিমাণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা ১২ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা আমানত তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে আট হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। অপরদিকে, আলোচ্য এসব ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শরীয়াহ ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত তিন লাখ ৭৫ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। আগের মাস ডিসেম্বরে তফসিলি ব্যাংকগুলোর আমানত ছিল ১৭ লাখ ৭০ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৮৪ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।

সেই হিসাবে গত ডিসেম্বর মাসের তুলনায় জানুয়ারিতে অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে তফসিলি ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে ১২ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এ সময় ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে আট হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। একই সঙ্গে জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। যা ডিসেম্বরে ছিল ১৯ লাখ ২৪ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ‌১৫২ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একীভূতকরণ নিয়ে অনেক আমানতকারীদের মধ্যে ভয় রয়েছে। কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হয় এবং একীভূত হলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না, এমন সন্দেহে অনেকেই টাকা তুলে নিচ্ছেন। এছাড়া মূল্যস্ফীতি বাড়ায় বাড়তি টাকার প্রয়োজন হওয়ায় অনেক গ্রাহক তাদের ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙানোসহ অন্যান্য সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিচ্ছেন। এটাও আমানত কমার একটি কারণ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে সুদের হার বাড়লে সাধারণত আমানত বাড়ে। তবে গ্রাহকের মধ্যে যদি আমানতের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তখন কিন্তু ওই সব গ্রাহক সুদের হার বাড়লেও টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিতে চাইবেন। হঠাৎ করে কমে যাওয়ার তো কোনো কোনো কারণ রয়েছে। বিশেষ করে সুদের হার বৃদ্ধির পরেও ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে ব্যাংক একীভূতে গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক। তবে তা শতভাগ নিশ্চিত হতে আরও অপেক্ষা করা যেতে পারে।”

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, “পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূতের ঘোষণার পর যে দুই ব্যাংকে টাকা তোলার হিড়িক পড়েছিল, তা গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। এ ছাড়া একীভূতের ১০টি ব্যাংকের কারণে যে ব্যাংকে আমানত কমেছে তা নিশ্চিত না হলেও একটা বড় প্রভাব যে ফেলেছে, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবাস্তব নীতি ও অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে অনিয়ম-জালিয়াতির খবর বেরিয়ে এলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্টো বিভিন্ন নীতি সহায়তা দিয়ে জালিয়াত চক্রকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষ কয়েক দফায় ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন করেছেন।

সম্প্রতি ব্যাংক একীভূতকরণের পদক্ষেপের মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মরত আলাউদ্দিন শাহাদাত সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি বলে দেয়, ওই ব্যাংকটি দুর্বল; তাহলে কোন বিশ্বাসে সেই ব্যাংকে গ্রাহক টাকা রাখবে। আর সব গ্রাহক যদি একসঙ্গে টাকা উত্তোলন শুরু করে, তাহলে কারও পক্ষেই তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।”

Link copied!