দিন যত বাড়ছে অস্থির হয়ে উঠছে ডলারের বাজার। বলা চলে- কালোবাজারিদের দখলে থাকা বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর হলেও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে ডলারের নতুন দাম। সবশেষ গত ৯ নভেম্বর পর্যন্ত খোলা বাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৭ টাকা। যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এ পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনে ডলার সংকটে দাম আরও বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দাম খোলা বাজারে বাড়তি চাহিদা তৈরিতে সহায়তা করেছে। তারা মনে করেন, খোলা বাজারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যখন ডলার প্রতি ১২৭ টাকা পাবেন, তখন তারা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো থেকে বিরত থাকবেন। ফলে একদিকে যেমন দেশে রেমিট্যান্স আসা কমে যাবে, অন্যদিকে ডলার সংকট ও বৈশ্বিক মন্দায় দেশের অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়বে।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) থেকে দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে ডলারের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এই মডেল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই একবারে না পারলেও আস্তে আস্তে বৈদেশিক মুদ্রার দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “এক্সচেঞ্জে তো বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে এবং সেটা দৈনন্দিন ভিত্তিতে রেট বদলাতে থাকে। কখনো উঠে আবার কখনো নামে। একটা সীমা বেঁধে দিলেন যে, ১১০ টাকার বেশি দিয়ে ডলার আপনি কিনতে পারবেন না। তবে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ভিন্ন একটা পথ বের করা হয়েছে।”
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার পথ থেকে সরে আসতে হবে। দাম ফিক্সড করে না দিয়ে আমরা যদি একটা করিডোর করে দেই। যেখানে রেট উঠানামা করতে পারবে এবং আমাদের ফরমাল চ্যানেলের যারা আছেন তারা ইনফরমাল চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ডলার কিনতে পারবে। সেই জায়গা যদি আমরা করে দেই তাহলে হয়তো এই সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে।”
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মো. হেলাল সিকদার বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দরে ডলার লেনদেন হচ্ছে না। গ্রাহক এসে ডলার না পেয়ে হাসি-ঠাট্টা করছেন। তারা বাধ্য হয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দরে ডলার কিনছেন।”
তথ্য বলছে, খোলা বাজারে একদিনের ব্যবধানে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ৫-৬ টাকা। গত ৯ নভেম্বর মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৭ টাকায়। অথচ একদিন আগেও এর দাম ছিল ১২১-১২২ টাকা। যদিও মানি এক্সচেঞ্জারদের জন্য ডলারের কেনা দর ১১৩ টাকা ৭৫ পয়সা এবং বিক্রির দর ১১৫ টাকা ২৫ পয়সা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে, এ রেটে কোনো মানি এক্সচেঞ্জে ডলার লেনদেন হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ডলারের দাম বেড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মানি এক্সচেঞ্জের বিক্রেতা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দেশে ডলার সংকট দিনকে দিন বাড়ছে। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গেলে চাহিদা মতো ডলার কিনতে পারছেন না। আর ব্যাংকেও এখন পর্যাপ্ত ডলার নেই। ফলে ডলারের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংকে না গিয়ে খোলা বাজারেই ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ।”
তিনি আরও বলেন, “ডলার এখন ১২৭ টাকা। তবু আমরা ডলার দিতে পারছি না। আমাদের কাছেও ডলার সংকট। ডলারের জন্য মানুষের হাহাকার অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে দাম বাড়তি নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। সরকার কঠোর হলেও আমাদের ব্যবসা করতে হবে।”
১২৭ টাকা করে একশ ডলার কিনেছেন মো. হাবিবুল ইসলাম। অর্থাৎ ১২৭ টাকা করে একশ ডলারের দাম আসে ১২ হাজার ৭শ টাকা। ব্যাংকে ডলার না পাওয়ায় দাম বেশি দিয়েই ডলার কিনতে হয়েছে তাকে। চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন আর ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তিনি।
সংবাদ প্রকাশের পরিচয় দিয়ে হাবিবুল ইসলামের কাছে বেশি টাকা দিয়ে ডলার কেনার কারণ জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে তিনি বলেন, “দেশের বাহিরে যাবো। কিছু ডলারের প্রয়োজন পড়বে তাই গত কয়েকদিন ধরেই পরিচিত বিভিন্ন জনের কাছে গিয়েও কোনো ডলার পাওয়া যায়নি। ব্যাংকেও গিয়েছি কয়েকবার। বেশি ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “এক ঘনিষ্ঠ ভাই জানালেন ডলারের কথা। মানি এক্সচেঞ্জের নাম বলবো না। তবে সেখানে গিয়ে ১২৭ করে একশ ডলার কিনতে হয়েছে। ডলার সংকট থাকায় কি একটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে আমাদের তা বলে শেষ করা যাবে না। অথচ অবৈধ মজুতকারিরা ঠিকই ডলার হাতে জমা করে রেখে বাজারে সংকট তৈরি করেছে। এখন সরকারের উচিত মাঠ পর্যায়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার।”
সংবাদ প্রকাশকে দেওয়া এক সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই বৈঠকে অবৈধ মজুতদার ও ডলারের বাজারের এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে এবং অর্থ পাচার ও হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানের পরামর্শ এসেছে। এছাড়াও বেনামি ও ভুয়া ঋণ ঠেকানো, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, তদারকি জোরদার ও ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নির্বাচনের পর আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কার আনা হবে। ডলার সরবরাহ বাড়লে ধীরে ধীরে দর বাজারভিত্তিক করা হবে। এ কারণে অনেকেই মনে করতে পারেন, আগামীতে ডলারের দর অনেক বাড়বে। যে কারণে ডলার ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সংকট আরও প্রকট হয়। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর।