নববর্ষে ‘শব্দসন্ত্রাস’ চান না ভুক্তভোগীরা


রাসেল হোসাইন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪, ০৯:৩৫ পিএম
নববর্ষে ‘শব্দসন্ত্রাস’ চান না ভুক্তভোগীরা

দিনভর অফিস করে সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছেন আলাউদ্দিন। একটু বিশ্রাম নিতে গিয়েই বাইরে হঠাৎ বিকট শব্দ। যেন কেঁপে উঠল গোটা ভবন। চিৎকার দিয়ে উঠল শিশুরা। ধড়ফড় করে জেগে গেলেন বৃদ্ধ মা। এমন আকস্মিক ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিন। তার বাসা রাজধানীর অভিজাত খ্যাত ধানমন্ডি এলাকায়। স্ত্রী রেহানা খানম জানালেন, কয়েকদিন ধরেই আশপাশের বাসার ছাদে সন্ধ্যা নামলেই পটকা ফোটাচ্ছেন তরুণরা। নিষেধ করলেও তারা শোনেননি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে আলাউদ্দিন বলেন, “থার্টি ফার্স্ট নাইটের আগেই যদি এভাবে পটকাবাজি শুরু হয়, তাহলে নববর্ষের দিনে কী হবে, অনুমান করা যায়। পুলিশ যতই কঠোর হোক, ছাদে ছাদে এসে তারা তো শব্দদূষণ বন্ধ করতে পারবে না। তাদের সে জনবলও নেই। তাই নিজেদের সচেতন হতে হবে। কিন্তু কেউই সচেতন নয়। শব্দসন্ত্রাস বন্ধে মহল্লায় মহল্লায় উদ্যোগ নিতে হবে।”

একই রকম ক্ষোভ প্রকাশ করলেন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা লায়লা রহমান। কয়েকদিন ধরেই এলাকার বিভিন্ন ভবনের ছাদে আচমকা পটকা ফুটছে। কখনো আতশবাজিও হচ্ছে। লায়লা রহমান বলেন, “সন্ধ্যা থেকে গভীর রাতের যে কোনো সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছে। ভবনে থাকা শিশু, অসুস্থ, বয়স্করা কেঁপে উঠছেন। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গিয়ে মানসিক অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে অনেকের।”

এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকার পেছনের একটি ভবনে থাকেন সিনিয়র সাংবাদিক শরীফা বুলবুল। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, “কয়েকদিন ধরেই দেখছি বাসার আশপাশের ভবনে হঠাৎ হঠাৎ বিকট শব্দে পটকা ফুটছে। এখনই যদি এমন অত্যাচার হয়, থার্টিফার্স্ট নাইটে তো বাসায় থাকাই যাবে না।”

শরীফা বুলবুল বলেন, “বাসায় আমি বিড়াল পুষি। সে তীব্র শব্দ সহ্য করতে পারে না। পটকা ফুটলেই বেচারা ছুটে গিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ে। থর থর করে কাঁপতে আর হাঁফাতে থাকে। খাটের নিচ থেকে বের করাই যায় না। শুধু কি বিড়ালেরাই ভয় পায়, আশপাশে গাছে ও ভবনে বহু পাখি বাস করে। পটকার শব্দে এরা দিশাহারা হয়ে পড়ে। বাসা ত্যাগ করে চলে যায়।”

মেজবাউদ্দিন নামে এক সংবাদকর্মী বাসা ভাড়া করে থাকেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায়। স্ত্রী, দুই শিশু সন্তান আর বাবাকে নিয়ে তার সংসার। তার বাবা আবার একজন হার্টের রোগী। কয়েকদিন ধরে হঠাৎ হঠাৎ করে বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে আশপাশের বাসা থেকে। এতে বাবার রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে অস্থির আচরণ করছেন। তাছাড়া হঠাৎ বিকট শব্দে ছোট দুই শিশুও চিৎকার দিয়ে ওঠে।

মেজবাউদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “থার্টি ফার্স্ট নাইট আসার আগেই যে অবস্থা, তাতে দ্রুত বাবাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া ছোট শিশুরাও ঢাকায় আর থাকতে চাচ্ছে না। তাদেরও গ্রামে পাঠাতে হবে। নববর্ষের উৎসব পার হয়ে গেলে তারা ফিরতে চায় রাজধানীতে।”

বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর ইস্কাটনে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নওরিন তাবাসসুম। তিনি বললেন, “হ্যাঁ আমাদের এলাকাতেও থার্টি ফার্স্ট নাইটের আগেই শব্দদূষণের মাত্রা বেড়েছে। এভাবে প্রতি বছরই তো নববর্ষে ব্যাপকহারে পটকা আর আতশবাজি ফোটানো হয়। যাতে মারাত্মক শব্দদূষণ আর বায়ুদূষণ ঘটে। সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেউ মানেন না। অন্যের ক্ষতি করে উৎসব করা তো অমানবিক। সচেতনতা ছাড়া এখান আমাদের থেকে মুক্তি নেই।’

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সংবাদকর্মী জাহিদুল ইসলাম আরিফ বলেন, “সরকার একদিকে পটকা, আতশবাজি আর ফানুস সহজলভ্য করছে, অন্যদিকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে এগুলো ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। এটা হাস্যকর পদ্ধতি। সরকার তো পটকা, আতশবাজি আর ফানুসের আমদানি আর উৎপাদন বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হয়। পটকা, আতশবাজির মতো ক্ষতিকর পণ্য বাজারজাত বা কেনাবেচা বন্ধ করাটাই সহজ সমাধান। কিন্তু সরকার এটা বুঝতে পারছে না কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

শুধু যে ঢাকাতেই পটকাবাজি ঘটছে তা নয়, বাইরের জেলাগুলোতেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই পটকা-আতশবাজি দেখা যাচ্ছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটের আগে এমন ঘটনা ঘটছে উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বারখ্যাত বগুড়া জেলা শহরেও। বগুড়ার কলেজশিক্ষার্থী জুনায়েদ ফারদিন জিসান বললেন, “সন্ধ্যা নামতেই দুষ্টু ছেলেপেলেরা বিভিন্ন বাসার ছাদে পটকা ফোটাতে শুরু করেছে। এতে অনেকের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটছে। হাসপাতালে রোগীদের সমস্যা হচ্ছে।”

জুনায়েদ ফারদিন জিসান প্রশ্ন রেখে বলেন, “পুলিশ তো আর ছাদে ছাদে গিয়ে দুষ্টু ছেলেদের ধরতে পারবে না, তাই এসব পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির পটকাবাজি বন্ধ করতে হলে প্রতিটি পরিবারের বড়দের দায়িত্ব নিতে হবে। দুষ্টু ছেলেদের নিষেধ করতে হবে, তারা যেন আনন্দ করতে গিয়ে অন্যের জীবনে ঝুঁকিতে না ফেলে।”

রাজধানীর পরেই বন্দরনগরীর অবস্থান। থার্টি ফার্স্ট নাইট আসার আগে চট্টগ্রামেও শুরু হয়েছে শব্দসন্ত্রাসের মহড়া। সন্ধ্যার পরই নগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ছাদে পটকা ফুটতে দেখা যাচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিশু, বয়স্ক নারী-পুরুষ, রোগী, বিশেষ করে হৃদরোগীদের জন্য এসব শব্দ অসহনীয় মাত্রার।

চট্টগ্রামের বাসিন্দা চাকরিজীবী আদর রহমান বলেন, “নিষেধজ্ঞা দিয়ে কাজ না হলে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। শব্দসন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে শিক্ষক আর অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ঘর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- সব জায়গায় পটকাবাজি বিষয়ে সচেতন করতে হবে। বিকটমাত্রার শব্দ উৎপাদনও যে এক ধরনের সন্ত্রাস তা বুঝাতে হবে তরুণদের।”

মূলত, ইংরেজি নববর্ষের ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ আসার আগেই রাজধানীসহ বিভাগ ও জেলা উপজেলা শহরের পাড়া-মহল্লায় শুরু হয়েছে আগাম পটকাবাজি। সন্ধ্যা নামতেই থেমে থেমে পটকা ফোটানো হচ্ছে বিভিন্ন ভবনের ছাদে ছাদে। যা চলছে মধ্যরাত অবধি। হঠাৎ করে এমন বিকট শব্দে আঁতকে উঠছে শিশু, বয়স্ক নারী-পুরুষ, হৃদরোগে আক্রান্ত ও পোষাপ্রাণীরা।

চিকিৎসকদের মতে, অতিরিক্ত মাত্রার উচ্চশব্দের কারণে শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, কান ভোঁ ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিসহ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।

এমতাবস্থায় জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের বিধিবহির্ভূত শব্দদূষণ কর্মকাণ্ড হতে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গত ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য অফিসার দীপংকর বর স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। তাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সবাইকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

Link copied!