আসন্ন রমজান ঘিরে অস্থির খেজুরের বাজার। ডলার সংকট, বুকিং রেট ও পরিবহন ব্যয় বেশি ইত্যাদি নানা কারণ দেখিয়ে প্রতিদিন দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। শুল্ক কমানো ও বাজার তদারকিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ এ খাদ্যটির দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। তিন-চার মাস আগেও যেসব খেজুরের দাম প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ছিল, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়।
সাইফুল ইসলাম নামের এক খেজুর ব্যবসায়ী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “রমজান এলেই খেজুরের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। যেমন খেজুরের কদর বাড়ে, তেমনি দামও বাড়ে। গত রমজানের চেয়ে এবার রমজানে আমাদের বিক্রির লক্ষ্য বেশি। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এবার রমজানের আগে থেকেই প্রতিটা খেজুরের দাম বৃদ্ধি। ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ফলে এর প্রভাব খোলাবাজারে পড়েছে। যাদের টাকা বেশি তারা আগেভাগেই অনেক খেজুর মজুত করে রেখেছেন। আমরা না পারছি খেজুরের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে, না পারছি বিক্রি বাড়াতে। তবে দাম মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বিক্রির সাথে লাভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছি।”
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয় গলা বা বাংলা খেজুর। প্রতি কেজি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৩০ টাকায়। যদিও গত বছর এ খেজুর প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। জাহিদি খেজুর এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৮০ টাকা কেজি দরে। গত বছরের দাম ছিল মাত্র ১৫০ টাকা। বাজারে দুই ধরনের দাবাস খেজুর পাওয়া যায়। মানভেদে এ খেজুর ৪৭০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর ছিল ৩০০-৩৪০ টাকা। সেই হিসেবে গলা, জাহিদি ও দাবাস—এ তিন খেজুরের দাম প্রায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে বরই খেজুর মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪৮০-৬১০ টাকা কেজি দরে। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ২২০-৪৩০ টাকায়। এ জাতটির দামও বেড়েছে প্রায় ৫১ শতাংশ।
এদিকে অভিজাত শ্রেণির কাছে পছন্দের খেজুরের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের মেডজুল, মাবরুম, আজওয়া ও মরিয়ম। বাজারে এগুলোর দাম সবচেয়ে বেশি। জাম্বো মেডজুল মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। সাধারণ মেডজুল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। গত বছর এর দাম উঠেছিল ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। মাবরুম খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। গত বছর ছিল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। বাজারে আজওয়া পাওয়া যায় দুই ধরনের। বর্তমানে এটি ১০০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর দাম ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি।
খেজুরের দাম বাড়েনি বলে দাবি আমদানিকারকদের। তাদের মতে, তিন-চার বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দাম যা ছিল এখন আবারও সে অবস্থায় ফিরেছে। মাঝের বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে সৌদিতে হাজিদের যাওয়া সীমিত থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে খেজুরের চাহিদা কম ছিল। যার কারণে দাম পড়ে গিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় খেজুরের আন্তর্জাতিক বাজারদর আগের অবস্থানে ফিরেছে। তবে দেশের বাজারে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন।
৩ কেজি খেজুর কিনতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাজমুল হোসেন। ১২৫০ টাকা দরে কেজিপ্রতি মাবরুম খেজুরের দাম শুনে কিছুক্ষণ বিক্রেতার সাথে আলোচনা করলেন দাম কমানোর জন্য। কিছুক্ষণ বিক্রেতার সাথে দাম নিয়ে দর কষাকষির এক পর্যায়ে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজিপ্রতি ৩ কেজি খেজুর দিতে রাজি হলেন বিক্রেতা শাহ-আলম।
দিন দিন খেজুরের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষোভ নিয়ে নাজমুল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দেশটা অনেকটাই ব্যবসায়ীদের হাতে নিয়ন্ত্রণ। যখন যেভাবে পারছেন তারা সেভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রোধে মাঠে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করলেও সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছেমতো বাজার অস্থিতিশীল তৈরি করছে তারা। ফলে বাজারে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ আগেও ছিল, এখনও আছে; ভবিষ্যতেও থাকবে।”
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে দায়ী করে তিনি আরও বলেন, “অনেক অসাধু সরকারি কর্মকর্তা আছেন যারা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মদতদাতা। এসব সরকারি কর্মকর্তাদের আশ্রয়ে ব্যবসায়ীদের ভয় ভেঙে গেছে। সিন্ডিকেট করে আয় করবে এক হাজার কোটি টাকা আর এর ৫০ শতাংশ ভাগ দিবে অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের, তাহলেই রফাদফা।”
রোজা ঘিরে খেজুর আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে সরকার। ফলে আমদানি বাড়ায় আড়ত পর্যায়ে সব ধরনের খেজুরের মজুত বেড়েছে। পাশাপাশি খুচরা বাজারেও বেড়েছে এর সরবরাহ। তারপরও নানা অজুহাত দেখিয়ে অতি মুনাফার আশায় সাধারণ মানুষের পকেট কাটছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে মাঠে সংশ্লিষ্টরা কাজ করলেও খুব বেশি একটা সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “এবারও পর্যাপ্ত খেজুর আমদানি হয়েছে। সরকার ১০ শতাংশ শুল্কও ছাড় দিয়েছে। তবে মনিটরিংয়ে দুর্বলতা রয়ে গেছে। এর ফলে খেজুরের বাজার ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে।”