• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজধানীতে তীব্র গরমে সমানে সমানে বেড়েছে যানজট


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪, ১০:০৯ এএম
রাজধানীতে তীব্র গরমে সমানে সমানে বেড়েছে যানজট

রাজধানী ঢাকায় তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রধান প্রধান সড়ক থেকে এলাকার সড়ক, সবখানে যানজট বেড়েছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষকে যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের মতো রাতেও যানজট থাকছে কোনো কোনো এলাকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, বাস-মিনিবাসের বিশৃঙ্খলা, যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা, প্রাচীন ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা, ট্রাফিক আইন না মানা, ট্রাফিক পুলিশের শিথিলতা, সড়কের একাংশজুড়ে বাস-ট্রাক রাখা, ছোট যানের আধিক্য, ফুটপাত দখল, ভাঙা সড়ক, সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, সব সড়কে রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অবাধ চলাচল রাজধানীতে যানজট আরও তীব্র করেছে। 

এ ছাড়া শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আন্তজেলা বাসের চলাচল, মহাসড়কের প্রবেশমুখে বাসের কাউন্টারও যানজট বাড়াচ্ছে। যানজট কমাতে উড়ালসড়ক (ফ্লাইওভার), এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিপুল ব্যয়ের অবকাঠামোও কাজে আসছে না। বরং হানিফ উড়ালসড়কের গুলিস্তানমুখী অংশে দুই-তিন কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে। সায়েদাবাদমুখী অংশেও দীর্ঘ জট হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, গত ৫ আগস্টের পর ১ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সড়কে নেমেছিল। সেগুলো আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। দূরপাল্লার বাসগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। জনগণ ট্রাফিক আইন নিয়ে একটু সচেতন হলে কাজগুলো আরও সহজ হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে দিনে প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অর্থমূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার সমান। এ হিসাবে বছরে যানজটে ক্ষতি ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীতে যানবাহন চলাচল কমে গিয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানী ছিল ট্রাফিক পুলিশশূন্য। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এসেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ট্রাফিক পুলিশ সড়কে ফিরলে শিক্ষার্থীরা সরে যান।

পটপরিবর্তনের সুযোগে সব সড়কে নেমে পড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নতুন সংকট তৈরি করেছে। ট্রাফিক পুলিশের কড়াকড়ি না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন এসব যানের চালকেরা। অথচ এসব যান আগে শুধু অলিগলিতে চলত।

রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে তিন থেকে ছয়জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা বলছেন, যানবাহনের চাপ বাড়ায় যানজটও বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাংলামোটর মোড়ের চারপাশে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। সেখান থেকে মগবাজার উড়ালসড়কের ওপর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে যানগুলো। অন্যান্য সড়কেও যানবাহনের সারি। বাংলামোটর থেকে মগবাজার পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান। সড়কের একপাশে গাড়ি রেখে মেরামতও করা হয়। ফলে সংকুচিত হয়ে গেছে সড়ক।

সায়েন্স ল্যাব মোড়, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, কলাবাগান ও নিউ এলিফ্যান্ট রোডে দিনভর তীব্র যানজট থাকে। এ এলাকায় রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান, হাসপাতাল। ব্যক্তিগত গাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যানবাহন সড়কের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বিপণিবিতানগুলো বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এসব এলাকায় যানজট থাকে। সাতমসজিদ রোডেও যানজট বেড়েছে। গ্রিন রোড ধরে পান্থপথ মোড়ে যেতে ঘণ্টা পার হয়ে যায়।

মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায়ও আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল। শিক্ষার্থীদের বহনকারী গাড়িগুলো সড়কের একাংশে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলে সড়ক সংকুচিত হয়ে যানবাহনের সারি দীর্ঘ হয়ে ভোগান্তি দিচ্ছে জটের। বিজয় সরণি মোড়মুখী বিভিন্ন সড়কেও তীব্র যানজট হচ্ছে। তেজগাঁওয়ে উড়ালসড়কের মোড়েও থাকছে জট।

রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী যেন যানজটের কেন্দ্র। যাত্রাবাড়ী–দোলাইরপাড় সড়কের দুই পাশ যেন বাস-মিনিবাসের টার্মিনাল। দোলাইরপাড় থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত যানবাহন গভীর রাতেও স্থবির থাকে। সায়েদাবাদ থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত রাতেও থাকে দীর্ঘ জট। আবার যাত্রাবাড়ী মোড়ের ওপাশের যানবাহনের সারি ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা পেট্রলপাম্প ছাড়িয়ে যায়। আন্তজেলা বাসগুলো সায়েদাবাদ টার্মিনাল ছাড়িয়ে আশপাশের সড়কগুলো দখল করে রাখছে। টিটিপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত আন্তজেলা বাসের কাউন্টার। ফলে দুই পাশের সড়কে যানজট লেগে থাকছে। টিটিপাড়ায় আইসিডি টার্মিনালে প্রবেশের মুখের ভাঙা সড়কের কারণে এখন জট ঠেকছে গোলাপবাগ পর্যন্ত। ভাঙাচোরা দয়াগঞ্জ মোড় যানজটের ভোগান্তিতে ফেলেছে ওই এলাকার মানুষকে। ইত্তেফাক মোড় থেকে হাটখোলা সড়কও ভাঙাচোরা।

যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ-গুলিস্তানমুখী সড়কের নিচের অংশের চেয়ে বেশি জট হানিফ উড়ালসড়কে। দিনে-রাতে কয়েক কিলোমিটার জট লেগে থাকে। নামাওঠার পথ চানখাঁরপুল, গুলিস্তান ও সায়েদাবাদ অংশে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে উড়ালসড়ক ব্যবহারকারীদের। গুলিস্তানে ওঠানামার মুখ দখল করে রাখছে বাস। সায়েদাবাদেও একই দৃশ্য।

আরেক প্রবেশপথ গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল মোড় এবং কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী পর্যন্ত সড়কেও যানজট বেড়েছে। কাউন্টারের সামনে থেমে থাকা আন্তজেলা বাসের এই জটের একটি কারণ। তবে রাতে ট্রাক চলাচল শুরু হলে এ পথে জট আরও তীব্র হয়।

রামপুরা-বাড্ডা-কুড়িল, মালিবাগ-মগবাজার আগে থেকেই যানজটের সড়ক বলে পরিচিত। এখন জট আরও বেড়েছে।

বাসচালকদের মোড়ে মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা এসব সড়কে জটের অন্যতম কারণ।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, গত ২০ বছরে যানজট নিয়ন্ত্রণে যেসব কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, সেসব ছিল জোগান বা সাপ্লাইকেন্দ্রিক। নীতিনির্ধারকদের আগ্রহের জায়গা শুধু অবকাঠামো তৈরিতে।

নগরে যানজটের আরেক কারণ ফুটপাত দখল। ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় পথচারীরা চলে সড়ক দিয়ে। ফলে সড়কে যানবাহনের চলাচলের অংশ কমে যাওয়ায় গতি ধীর হয়; যা অন্যত্র জটের সৃষ্টি করে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুনে বুয়েটের করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে।

গণপরিবহনের চেয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার মিলিয়ে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৫৪টি। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাস ৫১ হাজার ৩৮৪টি। মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার ৪ লাখ ৩১ হাজার ৬৭০টি। অর্থাৎ গণপরিবহন মাত্র ১০ শতাংশ।

রাজধানীর মোড়গুলোতে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাত নেড়ে গাড়ি চলা ও থামার সংকেত দেন। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এখন বাংলাদেশ ছাড়া সম্ভবত কোথাও নেই। যানজট নিয়ন্ত্রণে ছোট গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিক বাস রুট বন্ধ করতে হবে। বিলাসী প্রকল্পে বিনিয়োগ থেকে সরে আসতে হবে।

Link copied!