দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০২৪ ঘোষণা করেছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছে। আজকের বাংলাদেশ দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। সম্ভাবনার হাতছানি দেওয়া দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা দুরন্ত বাংলাদেশ। ছোটখাটো অভিঘাত আজ আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। করোনা মহামারিসহ নানা অভিঘাত মোকাবিলা করে সেই প্রমাণ আমরা রেখেছি।”
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ইশতেহার ঘোষণা করেন।
এবারের ইশতেহারের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’।
শেখ হাসিনা বলেন, “আজকের এ দিনে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ আওয়ামী লীগের প্রয়াত সব নেতাকে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা অকাতরে জীবন দিয়েছেন, সেই ভাষাশহীদদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। স্মরণ করছি ২০০৪ সালের ২১-এ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২২ জন নেতা-কর্মীকে। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক এবং ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাদের স্মরণ করছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা এখন ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। মাথাপিছু আয় (নমিনাল) ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার, যা ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেটের আকার ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা যা ১২ গুণ বৃদ্ধি। জিডিপির আকার ৪ লক্ষ ১৫ হাজার ৭২ কোটি টাকা থেকে ৫০ দশমিক ৩১ লাখ কোটি টাকা, যা ১২ গুণ বৃদ্ধি। রপ্তানি আয় ১০ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ৫ গুণ বৃদ্ধি। বার্ষিক রেমিট্যান্স আয় ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ৬ গুণ বৃদ্ধি। বার্ষিক রাজস্ব আয় ৩৭ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ অর্ধেক কমেছে। অতি দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা প্রায় ৫ গুণ কমে এসেছে। শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) ৮৪ জন থেকে ২১ জন, যা ৪ গুণ কমেছে। মাতৃমৃত্যু হার (প্রতি লাখে) ৩৭০ জন থেকে ১৬১ জন যা প্রায় আড়াই গুণ কমেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট থেকে ২৮ হাজার ৫৬২ মেগাওয়াট, যা ৮ গুণ বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগীর হার মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ থেকে মোট জনসংখ্যার ১০০ শতাংশ প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি।
তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার সময় আমি এবং আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম। সে কারণে আমরা প্রাণে বেঁচে যাই। দীর্ঘ ৬ বছর আমরা রিফিউজি হিসেবে প্রবাস জীবন কাটাতে বাধ্য হই। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জনগণের সমর্থন নিয়ে আমি দেশে ফিরে আসি। অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন সরকার, জাতির পিতার হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই আমি দেশে ফিরে আসি।”
তিনি বলেন, “১৯৯৬ সালের ২৩ জুন থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই - এই ৫ বছর পূর্ণ করে ২৬ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা ধান ও দানাদার শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করি। স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ, বয়স্ক, বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা প্রবর্তন এবং বর্গাচাষিদের বিনা জামানতে কৃষি ঋণ প্রদান করি”।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং নানা চক্রান্তের ফসল হিসেবে বিএনপি-জামায়াত-জোট ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। এরপরেই দেশে বিপর্যয় নেমে আসে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে ২২ নেতা-কর্মীকে হত্যা এবং ৫০০’র বেশি মানুষকে আহত করে।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে-
১. দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো।
৬. ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৭. নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা।
৮. সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা।
৯. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
১০. সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা।
১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।