এক সময় জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ছিলেন টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া। ১৯৯১ সালে সেবা প্রকাশনীর মাসিক ‘কিশোর পত্রিকায়’ সহকারী সম্পাদক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি শিশু সাহিত্য রচনা করতেন। তবে এসবের আড়ালে বাংলাদেশে বসে তিনি আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িত থাকার কারণে অনেক দেশে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফির অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে কামরুল ইসলাম নামের এক সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ।।
২০১৪ সালে শিশুদের পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের অপরাধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে প্রথম গ্রেপ্তার হন টিপু কিবরিয়া। ছয় বছর কারাগারে থাকার পর ২০২১ সালে কারামুক্ত হন তিনি। এরপরও স্বভাব বদলায়নি টিপু কিবরিয়ার। নজরদারিতে থাকা টিপু কিবরিয়াকে আবার গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
সিটিটিসি জানায়, আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের বাংলাদেশের মূলহোতা টিপু কিবরিয়া। তার বাসা থেকে ক্যামেরা পিসি, ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা ছবি ও এক হাজারের মতো ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া গেছে। শিশু পর্নোগ্রাফির ভুক্তভোগী শিশুরা সবাই ছিন্নমূল পথশিশু (ছেলে)।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “ঢাকা শহরের গুলিস্তান, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ছিন্নমূল পথশিশুদের পর্নোগ্রাফির কাজে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যুক্ত করতেন টিপু কিবরিয়া। সামান্য অর্থের প্রলোভনে বাসায় নিয়ে গিয়ে অশ্লীল ও গোপনাঙ্গের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক যে ক্লায়েন্ট আছে, তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বিদেশি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মাফিক বন-জঙ্গলে ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে গিয়ে পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও করতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নতুন মেগা ও টোটেনা নামক দুটি এনক্রিপটেড অ্যাপসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে পর্নোগ্রাফির কনটেন্টগুলো পাঠাতে শুরু করেন।”
সিটিটিসি প্রধান বলেন, “আমরা তার কাছ থেকে যে ডিভাইস উদ্ধার করেছি, তাতে দেখা গেছে, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিসহ আরও অনেক দেশের গ্রাহকদের তালিকা পাওয়া গেছে। যাদের কাছে তিনি বিকৃত ও অশ্লীল পর্নোগ্রাফির ভিডিও ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা সব ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস থেকে আমরা এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার অশ্লীল ছবি ও ১০০০ ভিডিও পেয়েছি। ফরেনসিক বা ফিল্টারিংয়ের কাজ শেষ হলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।”
সিটিটিসি জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে কিশোর কবিতা, গল্প ও ছড়া ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে তিনি ‘হরর ক্লাব’ নামে কিশোরদের জন্য সিরিজ গল্প লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেবা প্রকাশনী থেকে তার এসব লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। এক সময়কার তিনি খুবই জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য লেখার সময় তিনি অনেক শিশুর সঙ্গে মিশেছেন।
সিটিটিসি আরও জানায়, ২০০৫ সালের দিকে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ২০২১ সালে কারাগার থেকে বের হন। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘একশো এক’ নামক একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি সাহিত্য চর্চার আড়ালে পুনরায় শিশু পর্নোগ্রাফির সেই পুরোনো অপকর্ম শুরু করেন।
এর আগে, ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, টিপু কিবরিয়া টাকার বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের কাছে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও ও স্থিরচিত্র পাচার করে আসছিলেন।