রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাপে আছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী ডলারের সংকট চরম আকার ধারণ করে। এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে ভালোভাবেই দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না। সময়মতো অনেক পণ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাজারে পণ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা চলছে। হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকে। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনিবআর) রাজস্ব আদায়ে এরই মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গত বছর দেশে ডলার সংকট একটাই চরম আকার ধারণ করে যে খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৭ টাকা পর্যন্ত ওঠে। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সর্বোচ্চ দাম থেকে পিছু হাটে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যাংকে চাহিদা মতো ডলার না পাওয়ায় দেশের বাইরে যাওয়া বাংলাদেশিদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
তথ্য বলছে, ডলার সংকট সহনীয় পর্যায়ে না আসায় এই মুদ্রার দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে পারছে না আসন্ন মুদ্রানীতিতে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অর্থ হচ্ছে, বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়লে বিক্রি করা হবে, আর কমলে ক্রয় করা হবে। রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। আগামী ১৭ জানুয়ারির বিকেল ৩টায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। নীতি সুদহারসহ ব্যাংক ঋণের সবরকম সুদ আরও বাড়িয়ে সংকোচনমুখী ধারা অব্যাহত রাখা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ। গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে ও আগামী জুনের মধ্যে তা ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। গত নভেম্বরের শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নীতি সুদের হারও বাড়িয়েছে। এতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৮ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক সংকট নিরসনসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) থেকে দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে ডলারের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এই মডেল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই একবারে না পারলেও আস্তে আস্তে বৈদেশিক মুদ্রার দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার পথ থেকে সরে আসতে হবে। দাম ফিক্সড করে না দিয়ে আমরা যদি একটা করিডোর করে দেই। যেখানে রেট ওঠানামা করতে পারবে এবং আমাদের ফরমাল চ্যানেলের যারা আছেন তারা ইনফরমাল চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ডলার কিনতে পারবে। সেই জায়গা যদি আমরা করে দেই তাহলে হয়তো এই সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে।”