খিলগাঁও তালতলা এলাকার ফেরদৌস-আমেনা দম্পতি। চলতি মাসের ১৫ তারিখে একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে। এরপর থেকে সমস্যা পিছু ছাড়ছে না তাদের সংসারে। অকূল পাথারে (মহাবিপদ) নেমে অর্থেনৈতিক, মানসিক, শারীরিক সব ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন এ দম্পতি।
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রাজধানীর মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে কথা হয় তাদের সঙ্গে। ছয় সদেস্যর পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ফেরদৌস আর সংসারের দেখভাল করা স্ত্রী আমেনা ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ৬ দিনে তাদের খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকা। অবশেষে তারা ভর্তি হয়েছেন মুগদা হাসপাতালে।
চাপাকণ্ঠে ফেরদৌস রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “১৫ তারিখ থেকে আক্রান্ত হয়ে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। স্বল্প আয়ে সংসার চালাই। দুইটা ছেলে আছে, দেশে (জন্মস্থান) বাবা-মা থাকেন। যা আয় হয় বাব-মাকে পাঠাই। ঢাকায় সংসার চালাই। বউসহ দুজন আক্রান্ত হয়ে আজ হাসপাতালে।”
চোখের কোণে জল নিয়ে তিনি আরও বলেন, “বউসহ হাসপাতালে ২১ তারিখে ভর্তি হইছি। এখন দুইজনে আলাদা থাকি। ছোট দুইটা ছেলে থাকতে চায় না হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে ওষুধপত্র সব পাই। তারপরও তো খরচ আছে। আমাদের দেখাশোনা করছে আমার বোন, মামা। দেশ থেকে বাবা-মা আসছে। দিনের আয়ে, দিনে খাই। আজ প্রায় ৯ দিন থেকে বসে খাচ্ছি। এসব খরচ চালাতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা ঋণ করেছি। চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না।”
এদিকে দুজন একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্কিত স্ত্রী আমেনা বেগম। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এই সুস্থ হচ্ছি, এই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। হলাম তো হলাম, দুজনকে আল্লাহ্ একসঙ্গে বিছানায় ফেলে দিলেন।
এখন দুজনই আলাদা। তিনি (স্বামী) কেমন আছেন, হাঁটতে পারছেন কি না, খাচ্ছেন কি না কিছুই দেখতে পাই না। খালি আত্মীয়দের কাছে শুনি ভালো আছেন। বড় ছেলেটা আমার কাছে আর ছোটটা ওর বাবার কাছে আছে। কবে সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবো জানি না।”
শুধু ফেরদৌস-আমেনা দম্পতি না। রাজধানীসহ দেশের সকল স্থানের মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ‘ডেঙ্গু’। কোনো পরিবারে একজন অথবা একসঙ্গে দু’জন। আবার কোনো পরিবারে একে একে আক্রান্ত হচ্ছে সকলেই। ‘ডেঙ্গু’, রোগীসহ স্বজনদের শারীরিক ও মানসিকভাবে যেমন দুর্বল করছে। ঠিক একইভাবে সৃষ্টি করছে অর্থনৈতিক সমস্যার।
একই হাসপাতালে পাওয়া যায় মাতুয়াইল এলাকার মিজানুর রহমানকে। গত ২০ দিন ধরে তার বাড়িতে ডেঙ্গুর আসা-যাওয়া। প্রথমে বড় মেয়ে, তারপরে একে একে পরিবারের আরও ৩ সদস্য এবং সবশেষে তিনি আক্রান্ত।
একদিকে তার শুণ্য ভাণ্ডার, অপরদিকে উপার্জনের গাড়িটিও পুলিশ তুলে নিয়েছে। উভয় সংকটে পড়া এই মিজানুর বলেন, “আমি ইজিবাইক (ব্যাটারি চালিত) চালাই। এতে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে। ২০ দিন ধরে একের পর এক পরিবারের সবার ডেঙ্গু। তারপরে আমি ডেঙ্গুতে পড়লাম। খরচ চালাতে চালাতে ফতুর। ১০-১৫ হাজার ঋণ করে ফেলছি। ইজিবাইকটা আবার পুলিশে তুলে নিয়ে গেছে। কাগজপত্র নাকি ঠিক নাই। কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছি না। আল্লাহ্ কোন মুখে আছে জানি না।”
রাইদা বাসের ড্রাইভার জুরাইন এলাকার পারভেজ বলেন, “ছেলেটা গত ১০ দিন ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। হাসপাতাল থেকে যেতেও পারছি না। কারণ এখানে স্ত্রী একা। প্রতিদিন কাজ করে ৫-৬’শ টাকা আয় হয়। ছেলে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সব আয় বন্ধ। প্রাইভেট হাসপাতালে রাখছিলাম। সেখানে অনেক টাকা খরচ। চালাতে না পেরে এখানে (মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল) নিয়ে আসছি। হাতের টাকা পয়সাও শেষে হয়ে আসছে। শেষ হলে কই যাবো, কী করব জানি না।”
মান্ডা এলাকার শাহিন বলেন, “আক্রান্ত হয়ে ঋণ করছি ১০ হাজার টাকা। ১০ দিন ধরে বসে বসে খাইলাম। এখন শরীরের ওপর কী পরিমাণে চাপ পড়বে? তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ঋণের টাকা শোধ করা আবার নিজের সংসার চালানো। ডেঙ্গু আমাকে বিপদে ফেলে দিলো।”