ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটেছে শেখ হাসিনা সরকারের। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। শেখ হাসিনার পতনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান ৮ শতাধিক ছাত্র-জনতা। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় ১৮ হাজারের বেশি মানুষকে।
শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া আর তার সরকারের পতনের পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপ দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষ করে তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের শেষ দিকে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন মাধ্যমে তার সরকারের ভুল পদক্ষেপগুলো নিয়ে সমালোচক, সচেতন মহল এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন তুলতে থাকেন।
তবে শেষ দিকে এসে শেখ হাসিনা তার সরকারের কোনো রকম সমালোচনা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। যে কারণে বুদ্ধিজীবীসহ সংবাদমাধ্যমের ওপর দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। যারাই সরাসরি সমালোচনা করতে থাকেন তাদেরই থামিয়ে দেওয়া হতে থাকে।
শেখ হাসিনার শাসনকালে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার বাংলা। কল্লোল মোস্তফার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। যার মধ্যে ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ, পুলিশি নিপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অন্যতম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রচারণার মাধ্যমে দুঃশাসনকে আড়াল করার প্রাণপণ চেষ্টা করা হলেও শেষ অবধি শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঠেকানো যায়নি। মূলত, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ করার সঙ্গে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশি নিপীড়ন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
এছাড়া শেখ হাসিনার শাসনের সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন করা হয়। সরকার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠে। সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে গভীর জন অসন্তোষ জন্ম নেয়। যা শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় আঘাত করে।
শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এক পাক্ষিক রাজনৈতিক বয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল হাসিনার সরকার। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বানোয়াট পরিসংখ্যান তৈরি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নের প্রচারণায় এক চেটিয়াকরণের মাধ্যমে দুঃশাসনকে আড়াল করার চেষ্টা চলে। এতে হাসিনার জনপ্রিয়তা দিন দিন কমতে শুরু করে।
মূলত, নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কারসাজি, জ্বালানিখাতে লুণ্ঠন, বিদেশি ঋণনির্ভর ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প, বৈষম্য বৃদ্ধি, বিচারহীনতা, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্ব, তীব্র শ্রমশোষণ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, বানোয়াট পরিসংখ্যান, বন-নদী-পরিবেশের ক্ষতির কারণে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বারুদের বিশাল স্তূপের মতো জমা হচ্ছিল।
জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে শত শত তরুণকে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করলে ঘটনা বারুদের এই স্তূপে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে। যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়।