• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে যে শক্তি


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪, ০৪:০৩ পিএম
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে যে শক্তি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রীরা ছিলেন সংখ্যায় বেশি এবং অদম। ছবি: সংগৃহীত

নাম সাদিয়া নওরিন। একজন তরুণ চাকরিজীবী। স্নাতক শেষ করেছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক অদম্য সক্রিয় কর্মী।

কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত এক দফায় যুক্ত হয়েছিলেন একেবারে নিঃস্বার্থভাবে। প্রতিদিনই চিন্তা করে গেছেন হয়তো আর ফিরবেন না। তাই আন্দোলনে যাওয়ার আগে নিজের ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংকের বিবরণী ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সবকিছু বাড়িতে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। স্বজন-প্রিয়জনের কাছ থেকে বিদায়ও নিয়েছেন।

একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন ঘিরে সাদিয়া নওরিনের এমন দুর্দমনীয় মনোভাব একদিনেই গড়ে উঠেনি। তিনি পেছনের ইতিহাস নিয়ে বললেন, “আমার এমন সাহসিকতার রূপকার মূলত ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। সেই বছরের ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় দুই বাসের প্রতিযোগিতায় মারা যান শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের ছাত্র রাজীব ও দিয়া।

দুই সহপাঠীর মৃত্যু তখন সব শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের জন্ম দেয়। শুরু হয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। যা জুলাইয়ে শুরু হয়ে চলে আগস্টের মাঝামাঝি অবধি। যে কিশোর বা তরুণ তীব্রভাবে রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠেছিল, সেই সড়ক আন্দোলন তাদের মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত করে।

সে সময় সাদিয়া ছিলেন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনে। তবে তখন ভাবতেই পারেননি অরাজনৈতিক সেই আন্দোলন তার রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে চিরতরে বদলে দেবে।

নওরিন বলেন, “নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর থেকে আমি সবকিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করি। বিশ্বাস করতে শুরু করি যে প্রায় সবকিছুই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এটি আমাদের মৌলিক অধিকার। এটি আমাদের জীবনযাত্রাকে সংজ্ঞায়িত করে।”

বুক পেতেছি গুলি কর...

সাদিয়া আরও বলেন, “সেই আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে শুধু সড়কে নিরাপত্তা দাবির ছিল না, এটি ছিল সামগ্রিকভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। সবাই জানতো পরিবহন খাতে সরকার সমর্থিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গিয়ে ওই দুই মৃত শিক্ষার্থীর জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কম।”

সরকারের ভেতর জনবিরোধী সেই সিস্টেম অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করে নওরিনকে। তিনি বলেন, “তখন থেকেই আসলে আমি শিখেছি যে বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না। আমাদের অধিকারের জন্য অবশ্যই লড়তে হবে। তাই আমি যখনই কোনো মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান পাই, তখনই কাজ করতে প্রস্তুত থাকি।”

নিজস্ব সেই রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা তিনি ধারন করেছিলেন বছর চারেক ধরে। এরপর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হওয়া ২০২২ সালের আন্দোলনেও অংশ নেন তিনি। যা ছিল মূলত ছাত্রীদের আবাসিক হলে উন্নত সুযোগ-সুবিধার দাবিতে। তবে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ গুলি চালানোর কারণে তা এক দফা দাবিতে রূপ নিয়েছিল।

সাদিয়া নওরিনের মতোই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষবর্ষের শিক্ষার্থী সৈয়দ কিঙ্কেল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় তিনি সবেমাত্র এইচএসসি শেষ করেছেন। প্রাথমিকভাবে উত্তরায় আন্দোলন করেছেন।

স্মৃতিচারণ করে কিঙ্কেল বলেন, “সে সময় নবম শ্রেণি থেকে শুরু করে কলেজ শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমেছিল। সেই আন্দোলন আমাদের মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত করেছিল যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ভূমিকা আছে।”

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে সৈয়দ কিঙ্কেল বলেন, “এবারের (২০২৪) আন্দোলনে আমরা দেখেছি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা স্ব-উদ্যোগে রাস্তায় নেমে গিয়েছে। কোটা ইস্যুতে তাদের ব্যক্তিগত কোনো চাহিদাও নেই। তারপরও তারা এতে যোগ দিয়েছে।”

ফাগুন না আসতেই দ্বিগুণ হয়েছে আন্দোলনকারীরা...

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা অতীতের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে কিঙ্কেল বলেন, “আগের আন্দোলন থেকেই এটা সবার মধ্যে সেট হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে, এবার সবকিছু করা অনেক সহজ ছিল।”

উদাহরণ দিয়ে কিঙ্কেল বলেন, “উত্তরায় বিএনএস সেন্টার ও হাউজবিল্ডিং ছিল আমাদের জড়ো হওয়ার স্থান। তাই নতুন করে কোনো জড়ো হওয়ার জায়গা খোঁজার প্রয়োজন পড়েনি। সবাই জানতো কোথায় আসতে হবে।”

আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মতে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দুটি ভিন্ন বিষয়ের দাবিতে হলেও দুটি আন্দোলনই ছিল কিছু ক্ষেত্রে একরকম। কারণ বহু বছর ধরে চলা অন্যায় থেকে জন্মানো ক্ষোভই আন্দোলনগুলোকে শক্তি দিয়েছিল।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দিকে তাকালে তারা এখন নিজেরাই বিস্মিত হন। কারণ, সামান্য একটা কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলনে পরিণত হওয়া বিস্ময়কর। আর এর পেছনে রয়েছে অন্যায়কে ঠেকিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা।

আন্দোলনে যখন ক্রমাগত শহিদদের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের কথা, কোনো একক ঘটনার কারণে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হননি। এটি তার ১৫ বছরের কৃতকর্মের ফল।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল নায়ক তথা সমন্বয়কদের সাহস ও নেতৃত্বের আসল উৎস মূলত বিগত ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সড়ক আন্দোলন। এক্ষেত্রে তারা উদাহরণ দিয়েছেন সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমের। প্রতিদিনের কর্মসূচি ঘোষণা থেকে শুরু করে ডিবির হেফাজতে থাকা পর্যন্ত সব কিছুতেই তিনি জড়িত ছিলেন।

সড়ক আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নুসরাত তাবাসসুম বলেন, “সড়ক আন্দোলনের সময় আমি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। এটি আমার প্রথম আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল। আমি তখন কলেজ শিক্ষার্থী। জিগাতলায় যখন আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম হামলা চালানো হয় সেখানেও আমি ছিলাম। ওইদিনের অভিজ্ঞতা চিরকালের জন্য আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।”

শেখ হাসিনার পতনের পর গণভবনে উল্লাস।

নুসরাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। সেখানেও তিনি ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তবে নীরব না থেকে বরং এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর সারা দেশে পুলিশ কর্মকর্তারা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাজ থেকে বিরত থাকেন। তখন শিক্ষার্থীরাই দেশের শৃঙ্খলা ফেরাতে সড়কে নেমে পড়েন। সেই ২০১৮ সাল যেন ফিরে আসে। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বিশেষ লেন, প্রতিটি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখা থেকে শুরু করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তা পরিষ্কার সব ক্ষেত্রই শিক্ষার্থীদের দখলে।

যে তরুণরা ছিল প্রযুক্তি আসক্ত, তীব্রভাবে রাজনীতি বিমুখ সেই তরুণরাই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় হয়ে ওঠেন রাজনৈতিকভাবে দারুণ সচেতন। সেসময় তাদের জনস্বার্থমূলক আন্দোলনে জনসাধারণকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে নিজেদের সক্ষমতাও প্রমাণ করেছিলেন। বিশ্ব ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া বাংলাদেশের রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টের যে আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান তার বারুদ লুকিয়ে ছিল সেই ছয় বছর আগের সড়ক নিরাপদ আন্দোলনেই। সূত্র: টিবিএস।

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!