ছিনতাই ও প্রতারণায় এবার চট্টগ্রামের অপরাধীরাও ‘শয়তানের নিশ্বাস’ নামে পরিচিত স্কোপোলামিন নামের রাসায়নিক ব্যবহার করছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ধুতরার ফুল এবং আরও কিছু রাসায়নিকের মিশ্রণে তৈরি স্কোপোলামিন মেক্সিকো থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। এই ভয়ংকর রাসায়নিক প্রয়োগে মুহূর্তে কোনো ব্যক্তির স্নায়ুর কার্যকলাপ, মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে তখন ওই ব্যক্তি অন্যের কথায় কাজ করেন। সার্বিকভাবে ব্যক্তির চিন্তা-বুদ্ধি লোপ পায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো অস্ত্র ছাড়াই ওই ব্যক্তির সবকিছু নিয়ে নেয় ছিনতাইকারী ও প্রতারক চক্র।
মঙ্গলবার (২৮ মে) মো. জনি নামের অপরাধী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর স্কোপোলামিন ব্যবহারের তথ্য পায় পুলিশ। ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখতে পায়, ফাতেমা বেগম নামের এক নারী অপরাধী চক্রটির সদস্যদের পেছনে হেঁটে যাচ্ছেন। আর তাদের কথামতো নিজের কানের দুল, গলার চেইন খুলে দিচ্ছেন, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। স্বর্ণালংকার ছাড়াও নিজের কাছে থাকা এক হাজার টাকা, মুঠোফোন ও বাজারের ব্যাগ দিয়ে দেন। দেখে মনে হচ্ছে, অপরাধীরা তার পূর্বপরিচিত। পুলিশ বুঝতে পারে, ফাতেমার নাকের কাছে স্কোপোলামিন বা বুদ্ধিনাশক ওই রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
জানা গেছে, স্কোপোলামিন মূলত একটি কৃত্রিম রাসায়নিক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন–পরবর্তী জটিলতা কাটাতে এর ব্যবহার আছে। তবে এটি প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়, বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল ও পাউডার—দুই রূপেই পাওয়া যায়। তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে। মেক্সিকোর মাদক চক্রই এই মাদক বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নগরবাসীকে শয়তানের নিশ্বাস থেকে সচেতন থাকার পরামর্শ পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল কাদের পাটোয়ারীর। ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে নগরবাসীকে সতর্ক করতে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অপরিচিত কেউ কোনো কাগজ কিংবা জিনিসপত্র দিলে তা নাকের কাছে নেওয়া যাবে না।
ধুতরার ফুল থেকে স্কোপোলামিন বানায় কারা
স্কোপোলামিন মূলত একটি সিনথেটিক ড্রাগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার আছে।
তবে এটা প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়।তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে।
“আমাদের দেশে এক সময় মানুষকে পাগল করে দেওয়ার জন্য দুধের মধ্যে ধুতরা বেটে খাইয়ে দেওয়া হতো। ধুতরা ফুল কিন্তু একটা বিষ। ওই ধুতরা থেকে উপাদান নিয়ে সিনথেটিক্যালি এটা বানানো হয়েছে। মেক্সিকোর যে মাদক চক্র আছে, তারা এই মাদকটা বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে,” বলছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা।
স্কোপোলামিন কখন, কীভাবে কাজ করে
স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধ হিসেবে স্কোপোলামিনের ব্যবহার এখনো আছে।
“এটা এবং এর মতো আরও বেশ কিছু ওষুধ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়। এটা সত্য। স্কোপোলামিন প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জ্ঞিাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ এটা যদি ইনজেক্ট করে দেওয়া হয় তাহলে সে সত্য কথা বলতে শুরু করে। কারণ তার মগজের ওপর নিজস্ব যে নিয়ন্ত্রণ সেটা চলে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, অন্যের কথা শুনতে থাকে।”
“যখন আপনি কথা বলানোর জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ট্রুথ সেরাম। যখন আপনি পাউডার ফর্মে নিশ্বাসের জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ‘ডেভিলস ব্রেথ’। আর যখন এটা বমি অথবা মোশন সিকনেসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন তখন এটা আসলে মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে,” বলছিলেন মি. রহমান। সূত্র : প্রথম আলো ও বিবিসি বাংলা