পূর্ব-পশ্চিমের সুদীর্ঘ এক জলাশয়কে ঘিরে পরিকল্পিত সবুজ বেষ্টনী দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল প্রকল্প। চক্রাকারের সুশোভিত ও মনোরম পরিবেশের এই স্থানটি যেমনটা পরিবারের জন্য, তেমনটা সর্বজনীনও। যুগলদের জন্যেও স্নিগ্ধতায় ভরা অসাধারণ এক জায়গা। আবার কর্মক্লান্ত নগরবাসীর স্বস্তির নিশ্বাস গ্রহণেরও এক অনবদ্য স্থান।
স্বস্তির এমন জায়গাটিতে ঘটে চলেছে নানা রকমের অস্বস্তিকর আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সংঘটিত হচ্ছে ভয়ংকর অপরাধ। এই অপরাধ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। গত ৯ বছরে ২১ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে হাতিরঝিলের বিভিন্ন স্থান থেকে। গাড়িচাপায় মৃত্যু হয়েছে শতাধিক। ছিনতাইয়ের ঘটনা যেন এখানে নিত্যকার বিষয়।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ জুলাই হাতিরঝিল লেক থেকে ভাসমান অবস্থায় এক অজ্ঞাত তরুণের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২০২২ সালে ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে এক যুবক আত্মহত্যা করে। তার কয়েকদিন আগে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের এক সাংবাদিকের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালে আমবাগান এলাকায় প্রাইভেটকারের ভিতর থেকে স্বামী-স্ত্রীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা হাতিরঝিলের নানাপ্রান্তে ঘটেই চলেছে।
২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি গভীর রাতে হাতিরঝিলে রহস্যজনক মৃত্যু হয় দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হাবীব রহমানের। তাঁর ব্যবহার করা মোটরসাইকেলটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আসমা বেগম নামের এক নারীর ভাসমান লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর মেরুল-বাড্ডাসংলগ্ন হাতিরঝিল থেকে উদ্ধার করা হয় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিজুল ইসলাম মেহেদীর লাশ। সে বছর বিরোধের জেরে খুন হয় শিপন হাসান নামের আরেকজন। ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিলের কুনিপাড়ার লেক থেকে একটি এবং ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আরেকটি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল দিনের বেলায় স্বাভাবিক থাকলেও রাতে হয়ে ওঠে অপরাধীদের অপকর্মের নিরাপদ আস্তানা। মহানগর ব্রিজ ও মধুবাগ ব্রিজে গভীর রাতে চলে মাদকসেবীদের আড্ডা। ধনীর দুলালরা মদপ্য অবস্থায় গাড়ির রেস করে এখানে। রাতে সাধারণ মানুষের চলাচল কম থাকায় বিভিন্ন স্থানে চলে মাদকসেবীদের আড্ডা, এসব অভিযোগ স্থানীয়দের। অন্ধকারকে পুঁজি করে আরও চলে বিভিন্ন রকমের অপকর্ম।
মহানগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুনশান হয়ে যায় হাতিরঝিলের পুরো এলাকা। রাস্তায় পুলিশের টহলও থাকে না। বখাটে তরুণরা ঘুরে বেড়ায় মটরসাইকেল নিয়ে এপাড়-ওপাড়ে। ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এখানে রাতের বেলায় চলাচল করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।”
মধুবাগ এলাকার এক বাসিন্দা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “হাতিরঝিলের সঙ্গে বেগুনবাড়ি, কুনিপাড়া, তেজগাঁও, বাড্ডা, উলন, মহানগর ও মধুবাগ এলাকায় অন্তত ৩৮টি গলি রয়েছে। সেতুগুলোর ওপর ও পাশে আছে কিছু অন্ধকার এলাকা, সেখানে ঘটে অপরাধ কর্মকাণ্ড। পুলিশের টহল গাড়ির সামনেই মাদক বিক্রি ও সেবন হয়।”
বেগুন বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সন্ধ্যার পর থেকে এখানকার সংযোগ সেতুর আশপাশেই মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের তৎপরতা শুরু হয়। সড়কের বেশিরভাগ লাইট নষ্ট থাকায় সেখানে জুটিবদ্ধ হয়ে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতেও দেখা যায়। গভীর রাতে এখানে পতিতাদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। ”
জানা যায়, এলাকাটিতে অপরাধীদের আধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় আতংকিত এখানকার বাসিন্দারা। এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাও সন্ধ্যার পর আতঙ্কে থাকেন।
এসব অপরাধ সম্পর্কে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মো. আওলাদ হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “হাতিরঝিলের পুরো এলাকাটির বেশিরভাগ অংশ আমাদের থানার মধ্যে। আর একটা অংশ তেজগাঁও থানার মধ্যে। ফলে অপরাধের ঘটনার আলাদা পরিসংখ্যান নেই আমাদের কাছে।”
তিনি আরও বলেন, “ছুটির দিনগুলোতে দর্শণার্থীদের ভিড় থাকায় দিনে ও রাতে আমদের টহল টিম জোরদার থাকে। ব্রিজগুলোর দুই পাশে দুটি চেক পোস্ট কাজ করে। সারাদিন দুই থানার সমন্বয়ে মোবাইল টিম কাজ করে। অধিক নিরাপত্তার জন্য রাত ১২টার পর চলাচলও নিয়ন্ত্রিত থাকে। অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ”
হাতিরঝিল প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির আহবায়ক মেজর শামসুউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রকল্প এলাকার নানা ঘটনা নিয়ে এলাকাবাসী অভিযোগ করছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। এটি রাজউকের একটি প্রকল্প। রাজউক শুধু এখানে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আমরা আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে তাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু অপরাধ ঘটলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।”
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “ব্রিজগুলোর নিরাপত্তার জন্য রেলিং ঘেঁষে বসে কেউ যেন অযথা আড্ডা দিতে না পারে, এ জন্যই কাঁটাতার বসানো হচ্ছে। আরও বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আমাদের ৪৯জন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করেন। তারা নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছে।