• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে সর্বাধিক আসন পায় আ.লীগ


রাসেল হোসাইন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪, ১০:০৪ পিএম
সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে সর্বাধিক আসন পায় আ.লীগ
ভোট দিয়ে ‘ভি চিহ্ন’ দেখান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় সঙ্গে ছিলেন হাসিনা-কন্যা সায়মা ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা ও রেহানা-পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। ছবি : সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়ার আগে প্রায় ১৬ বছর টানা দেশ পরিচালনা করেছে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আরও তিন টার্ম ক্ষমতায় আসে দলটি। তবে ক্ষমতায় থাকলেও তাদের নির্বাচন নিয়ে ছিল নানা বিতর্ক। ক্ষমতার অপব্যবহার, চাপ প্রয়োগ, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে দলীয়করণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল বলে অভিযোগ করেছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো।

তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ছিল ২৪-এর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের পর বেশি জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা—৬২টি আসনে। ওইসময় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছিল মাত্র ১১টি আসনে।

সর্বশেষ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভোট পেয়েছিল ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এই তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া যেসব আসনে জাতীয় পার্টি লড়েছে, সেখানে তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এর বাইরে ভোটে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোর সবারই ভোট পাওয়ার হার নগণ্য।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদে ১৩টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এরপর ষষ্ঠ সংসদ বাদে সব সংসদেই প্রতিনিধিত্ব ছিল ছয় থেকে নয়টি দলের। আর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় ২৮টি দল। তবে এর মধ্যে ২৩টি দলের কোনো প্রার্থী ভোটে জিততে পারেননি।

৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৪১.৮ শতাংশ। ওই সময়কার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ তথ্য জানিয়েছেন। ভোটের দিন বিকেল ৩টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন ভোট পড়েছে ২৬.৩৭ শতাংশ। এরপর ভোট গ্রহণের শেষ ঘণ্টায় অর্থাৎ বিকেল ৫টার সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশের মতো।

পরদিন ৮ জানুয়ারি ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার সময় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, মোট ভোট পড়েছে ৪১.৮ শতাংশ। এসময় সাংবাদিকরা সিইসি হাবিবুল আউয়ালকে প্রশ্ন করেন যে, ‘ভোটের দিন বিকেল ৩টায় ২৬.৩৭ শতাংশ এবং ৫টার সংবাদ সম্মেলনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ দুই ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ১৩ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক বলে নানা মহলে সমালোচনা হচ্ছে।’

এবিষয়ে সিইসি বলেন, “যখন ২টা কিংবা ৩টায় তথ্য দেওয়া হয়, সেটা কোনোভাবেই সঠিক নয়। যখন রাত ১০টায় বলি, তখন সব তথ্য চলে আসে এবং সঠিক তথ্যটি জানা যায়। এখন ভোটের শতাংশ দাঁড়িয়েছে ৪১.৮ শতাংশ। কারও যদি সন্দেহ থাকে তাহলে তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারে।”

এদিকে ফলাফল ঘোষণার পর নানা কারচুপি ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন পরাজিত প্রার্থীরা। ভোটের পর শেষ বেলায় প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারাসহ কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন ভোটে হেরে যাওয়া প্রার্থীদের অনেকে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো অভিযোগকারীর মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থী ও দলটির নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া অভিযোগকারীদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় পার্টি, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নতুন দলগুলোর প্রার্থীরা।

ইসির তথ্য অনুযায়ী, ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দল নির্বাচন বর্জন করে।

ভোটকেন্দ্রে সেলফি তেলেন শেখ হাসিনা। সেলফিতে নেতৃত্ব দেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ ও শেখ রেহানা। ছবি : সংগৃহীত

সরকার নির্বাচনকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক দেখাতে ভোটে দলের সংখ্যা বাড়াতে সচেষ্ট ছিল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন দলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের পর (২৭ এপ্রিল) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে এক বর্ধিত সভায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা জি এম কাদের বলেন, “দ্বাদশ নির্বাচনে যাবার জন্য বিভিন্ন চাপ এসেছিল। ১৭ ডিসেম্বর (২০২৩) আমি নির্বাচন থেকে সরে আসার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তারপর চাপ আসলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ চাপের কথা আমি বিস্তারিত বলবো না, আপনারা বুঝে নেবেন।”

শেখ হাসিনার প্রতি ইঙ্গিত করে জিএম কাদের বলেন, “দেশে তার ‘ওয়ান পার্টি রুল’ চলছে। এতে করে রাজনৈতিক শূন্যতা ও চরমপন্থার সৃষ্টি হতে পারে। এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা না গেলেও নির্বাচন হতো। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে সরকারের সেরকম প্রস্তুতি নেওয়া ছিল।”

এদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিএনপি কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে আগে থেকেই বলে আসছিলেন দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। ওই সময় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “এই সরকার (আওয়ামী লীগ) নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসেনি, জোর করে এসেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা ১৫৪ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করে সংসদ গঠন করেছে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আগের রাতে ভোট ডাকাতি করে সরকার গঠন করেছে।”

আওয়ামী লীগকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আবার সামনে নির্বাচন (দ্বাদশ) আসছে। একইভাবে এই সরকার আবারও একটা পাতানো, ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের পায়তারা করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভোট কখনো নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে না। এবার আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো তামাশার নির্বাচন হতে দেব না। এ দেশের মানুষ তা হতে দেবে না।”

এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাতে বিএনপি অংশ নেবে না বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলকেও জানিয়েছিল দলটি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সফরে আসা ইইউ-এর প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানিয়েছিল বিএনপি।

Link copied!