গেল কয়েক বছরের তাপপ্রবাহের চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা আর যশোর সম্প্রতি তাপমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তীব্র গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শনিবার (২০ এপ্রিল) যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাওয়া এবারই প্রথম নয়, প্রতিবারই তীব্র দাবদাহ থাকে এই অঞ্চলে।
আবহাওয়ার এমন প্রবণতা ব্যাখ্যা করেছেন আবহাওয়াবিদরা। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, “যশোর, চূয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, খুলনা অঞ্চলে রয়েছে বিস্তৃত সমভূমি। এছাড়া এই অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বিশাল এলাকা জুড়ে সমভূমি। তাপমাত্রা প্রবাহের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে, পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ। এসব পদ্ধতির মধ্যে সমভূমি হওয়ার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে পরিবহন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হয়। ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে পুরো অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে।”
দ্বিতীয়ত, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা দিয়ে জলীয় বাষ্প প্রবেশ করায় তাপমাত্রা বাড়ে। আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, “বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমঘাট হচ্ছে খুলনা, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল। আর বঙ্গোপসাগর হচ্ছে জলীয় বাষ্পের উৎস। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে বলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অন্যান্য এলাকার তুলনায় এই এলাকায় বেশি থাকে। ফলে তাপমাত্রাও বেশি থাকে।”
একেএম নাজমুল হক আরও বলেন, “এখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন যদি বাতাসে আরও ২০ শতাংশ জলীয় বাষ্প ঢুকিয়ে দিই, তাহলে ওই ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি না থেকে ৪১ বা ৪২ ডিগ্রিতে রূপ নিতে পারে।”
তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সূর্য থেকে চুয়াডাঙ্গার অবস্থান বা সোলার পজিশন। সূর্যের উত্তরাঞ্চলের কারণে তাপমাত্রা বাড়ে। পৃথিবী সাড়ে ২৩ ডিগ্রি কোণে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ফলে ২১ মার্চের পর থেকে ২১ জুন পর্যন্ত উত্তর মেরুতে সবচেয়ে বেশি সূর্যের তাপ পৌঁছায়। আর বাংলাদেশ যেহেতু ২২ ডিগ্রি থেকে ২৬ ডিগ্রি এরকম অবস্থানে আছে এবং কেন্দ্র রয়েছে ২৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। ফলে সূর্যের যে সর্বোচ্চ কিরণ সেটা কিন্তু পড়ে এই সব অঞ্চলে। যে কারণে এই অঞ্চলে তাপমাত্রাটা বেশি থাকে।”
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, গরমকালে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ থাকলেও শীতকালে অবশ্য সেটি থাকে না। বরং শীতকালে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসে, চুয়াডাঙ্গা সেসব অঞ্চলের অন্যতম।
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে তাপমাত্রা শীতকালে কম থাকার কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, “এর জন্য দায়ী আসলে শীতকালে প্রবাহিত শুষ্ক বাতাস।”
শীতকালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে শুষ্ক বাতাস বয়ে যায় তা সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে এই শুষ্ক বাতাস বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। হিমালয়ের একপাশ দিয়ে শুষ্ক বাতাস ঢুকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, চুয়াডাঙ্গা এসব অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে।
আর দ্বিতীয়টি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে। এই দুটি বায়ু-প্রবাহের মধ্যে যেটি বেশি সক্রিয় বা শক্তিশালী থাকে সেবছর ওই অঞ্চলে বেশি শীত অনুভূত হয়।