মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে সাধারণ মানুষের। আয় না বাড়ায় নিত্যপণ্যের বাজারে হাঁসফাঁস অবস্থা। এমন অবস্থার মধ্যেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সংকোচনমূলক বাজেট প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক থেকে এই রাজস্ব আদায় করা হবে। যাতে উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিটি ধাপে ভ্যাটের হার বেড়ে যাবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি ও ডলার সংকটে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে জীবনযাত্রায়। একদিকে মানুষের আয় বাড়েনি, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়েই চলেছে। আসছে বাজাটে ভ্যাট বাড়ানো হলে অনেক খাতে খরচ আগের চেয়ে বেড়ে যাবে। এতে মধ্য আয়ের বেশিরভাগ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে তাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আসছে অর্থবছরে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করতে হবে। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা বেশি। আর এই বাড়তি ভ্যাট কীভাবে আদায় হবে তার একটা গাইড লাইনও গত সপ্তাহে এনবিআরকে পাঠিয়েছে আইএমএফ। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসা কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
আইএমএফের গাইডলাইনে প্রত্যাশা রাখা হয়, ভ্যাট কার্যালয়ের নিয়মিত ব্যবস্থা নেয়ার ফলে রাজস্ব আয় ১১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে গিয়ে হবে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকি ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ‘বাড়তি’ ব্যবস্থা নিয়ে আদায় করা হবে।
ভ্যাট বিভাগের প্রত্যাশা, বাড়তি হিসেবে তারা ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে পারবে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা আদায় করা হবে সিগারেট করব্যবস্থা পুনর্গঠনের মাধ্যমে। ট্রেডিং পর্যায়ে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস সিস্টেমের যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে এ খাত থেকে আসবে বাড়তি ৯৫০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে গেল অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রাজস্ব আয়ের গতিধারা বিশ্লেষণ করে বলেছে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায়।
কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এনবিআর রাজস্ব আদায় বাড়াতে বেশকিছু পরিকল্পনা তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে চলতি বছরের ৫০ লাখ টাকার বদলে আসছে অর্থবছর থেকে ১০ লাখ টাকা বা তার অধিক পরিমাণ ভ্যাটের জন্য ই-পেমেন্ট বা স্বয়ংক্রিয় চালান বাধ্যতামূলক করা। জেলা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় বাড়াতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৬০ হাজার ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে।
এনবিআরের পরিকল্পনায় আয়কর আইন-২০২৩ বাস্তবায়ন করে নতুন করদাতা শনাক্তকরণে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), নির্বাচন কমিশন এবং সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ, গাড়ির মালিক, অধিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ব্যক্তি, নির্বাচনী প্রার্থীদের সম্পদ তালিকা ও সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তারাও দীর্ঘদিন ধরে আয়কর বাড়ানোর জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করে আসছে। ক্যাবের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, “ভ্যাটের ভার যেহেতু সবার ওপরে যায়, এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। সেজন্য ভ্যাট না বাড়ানোর জন্য বলে আসছিলাম। কিন্তু এনবিআর আমাদের কথা শুনছে না।”
এসএম নাজের হোসেন আরও বলেন, “মানুষ এমনিতেই বছর দুয়েক ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছে। ফলে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এর মধ্যেও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে সরকার ভ্যাট হিসেবে বাড়তি টাকা আদায় করেছে। নতুন করে আবার ভ্যাটের চাপ দেওয়া হলে তা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য অসহনীয় হবে।”
এদিকে, এনবিআর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট ভ্যাট আয়ের ১০ শতাংশ আসে সরকারি প্রকল্প ও অন্যান্য সংস্থার কেনাকাটা থেকে আহরণ করা ভ্যাট থেকে। চলতি বছর এ খাতে রাজস্ব আদায় কমতে পারে, কারণ অনেক কোম্পানি ও সরকার ইতোমধ্যে তাদের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, আসছে বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর লক্ষ্যে করজাল বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও শতভাগ সম্পন্ন হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাজেটের ঘাটতি কম ধরতে হবে। যেটুকু ঘাটতি ধরা হবে, সেটি যতদূর সম্ভব বিদেশি ঋণে মেটাতে হবে।”
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, “আমরা রাজস্ব আদায় খুব একটা বাড়াতে পারবো না। সে কারণে বাজেটের আকার ছোট রাখা উচিত। রাজস্ব বাড়াতে কিছু করছাড় কমাতে হবে। সরকারের বাজেট সাপোর্টের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ঋণ নেওয়াও কমাতে হবে। তা না হলে বাজার খুব অস্থিতিশীল থাকবে।”