হঠাৎ ‘ক্রাইম হটস্পট’ মোহাম্মদপুর, অভিযানেও কাটছে না আতঙ্ক


রাসেল হোসাইন
প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৪, ০৯:০০ পিএম
হঠাৎ ‘ক্রাইম হটস্পট’ মোহাম্মদপুর, অভিযানেও কাটছে না আতঙ্ক
নবোদয় হাউজিং বি-ব্লকে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও থেকে নেওয়া।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর। নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠতেন সবাই। সেই নব্বইয়ের দশকে ‘সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। রাজনৈতিক মদদ আর প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার সুযোগে এখানে আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন রাজধানীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ-অপ্রতিরোধ অপরাধীরা। দিনে দুপুরে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছিল সেসময়। বছরের পর বছর ধরে অপরাধীদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো বাসিন্দাদের।

তবে এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সমঝোতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অপরাধীদের সেই ‘স্বর্গরাজ্য’ শান্ত হয়ে আসতে থাকে। ভয়ঙ্কর বেপরোয়া সন্ত্রাসীরাও তাদের অপরাধ কমাতে বাধ্য হয়। তবে নব্বইয়ের সেই পরিস্থিতি হঠাৎ করেই ফিরে আসে মোহাম্মদপুরে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর কয়েকদিনেই অতি ভয়ঙ্কর চেহারায় রূপ নেয় এলাকার অপরাধী চক্র। একের পর এক ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, নির্যাতনের ঘটনায় ভীত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাটি হঠাৎ করেই ‘ক্রাইম হটস্পটে’ পরিণত হওয়ায় বাসিন্দারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন হঠা বদলে যেতে থাকে। সন্ধ্যা নামতেই থমথমে হয়ে যায় এলাকার প্রতিটি আবাসিক ভবন আর সড়কগুলো। কখন, কোথায়, কীভাবে, কে যে অপরাধের শিকার হবেন, অনুমান করতে পারছেন না কেউ। দিন নেই রাত নেই, যখন তখন ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, চাঁদাবাজিতে অস্থির হয়ে ওঠেন এলাকার সাধারণ মানুষ। একই সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মাদক কারবারিরাও। অনেকের কাছে নব্বইয়ের দশকের সেই স্মৃতি ধরা দেয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রমতে, গেল আড়াই মাসে মোহাম্মদপুরে ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাতজনকে কুপিয়ে, দুজনকে গুলি করে আর সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন একজন। নিহতদের মধ্যে একজন ছিনতাইকারীদের হাতে, মাদক কারবার নিয়ে দ্বন্দ্বে ছয়জন আর বাকি তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন আধিপত্য বিস্তারে রেষারেষিতে। স্থানীয়রা বলছেন, মোহাম্মদপুরে দিনেদুপুরে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।

হঠাৎ অপরাধীরা মাথা চাড়া দেওয়ায় যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করে। ইতোমধ্যে অনেক অপরাধী ধরাও পড়েছে। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, অভিযানের কারণে অনেক অপরাধী গা ঢাকা দিয়েছে। অভিযান শেষ হলেই তারা ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। স্থানীয় বাসিন্দারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদে জোরদার অভিযানের দাবি করেছেন, যেন অপরাধীরা নির্মূল হয়।

সাবের হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “কখন যে ছিনতাইকারীরা চলে আসে বলা যায় না। প্রতিদিন তিন রাস্তার মোড়, চাঁদউদ্যান, মোহাম্মাদী হাউজিং, কাদেরাবাদ হাউজিং, কাটাসুর, বেড়িবাঁধ এলাকায় ছিনতাইয়ে ঘটনা ঘটে। অভিযান শুরু হলে ছিনতাইয়ে ঘটনা কমে পরে আবার বাড়ে।“

কিছুদিন আগে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সংবাদ প্রকাশের রিপোর্টার জাহেদুল ইসলাম আরিফ। সেখানে তার হাতে কোপ দিয়ে সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা নিয়ে যায় একদল ছিনতাইকারী। তিনি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, “হুট করেই ৪-৫ জন তরুণ দেশীয় অস্ত্র হাতে এসে সবকিছু দিয়ে দিতে বলে। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতে কোপ বসিয়ে দেয়।”

সজিব হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, “কিছুদিন আগে এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি বেড়ে গিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ অভিযান শুরু করলে অপরাধ কিছুটা কমে আসে। তবে, এখনো এলাকাবাসীর শঙ্কা কাটেনি। আমরা চাই প্রশাসনের এই অভিযান অব্যাহত থাকুক।”

তবে সন্ত্রাসীদের কারণে শিক্ষার্থী ও সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না মোহাম্মদপুরের শিক্ষক ও অভিভাবকদের। মোহাম্মদপুর ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জামাল হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বর্তমানে প্রশাসনের যে অভিযান চলছে, অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অপরাধ প্রবণতা আগের চেয়ে অনেকটা কমেও এসেছে। তবুও আমরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চিন্তায় থাকি। প্রশাসন যদি এই অভিযান অব্যাহত রাখে, তাহলে আশা করছি আর দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।”

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন সাকিফ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় অনেক থানায় হামলা হয়েছে। পুলিশের যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার অনেক পুলিশ সদস্য এখনো কাজে ফেরেননি। পুলিশের আন্তরিকতা থাকলেও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। যে কারণে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।”

রাজধানীর মোহাম্মদপুর

তবে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী মনে করেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর যে অভিযান চলছে তা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে না। তবে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি এলাকাবাসী সহযোগিতা করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় রাখা সম্ভব হবে।

অবশ্য, মোহাম্মদপুরকে ঐতিহ্যগতভাবে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা। রাজধানীর অন্যান্য থানার তুলনায় মোহাম্মদপুর যেমন আয়তনে বড়, তেমনি বেশি অপরাধীদের বিচরণক্ষেত্রও। তাছাড়া জেনেভা ক্যাম্প নামের অতিঘন জনবসতির এলাকা ঘিরে অপরাধীদের আনাগোনা এমনিতেই বেশি। ফলে আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা অনেক সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় বলে দাবি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকার মধ্যে দশজন টপটেররের তালিকা করলে দেখা যাবে ৫-৬ জনেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা মোহাম্মদপুরে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সহকর্মীদের নিয়ে অপরাধ দমনে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে দুইশর মতো সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পিস্তল, দেশীয় অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ মাদকও উদ্ধার করা হয়েছে।”

আলী ইফতেখার আরও বলেন, “বর্তমানে এলাকাবাসীর মধ্যে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। মানুষ রাতে যেকোনো সময় নিঃসংকোচে বের হতে পারছেন। তবুও আমার যেটা দায়িত্ব আমি শতভাগ অপরাধ দমনে কাজ করে যাব।”

Link copied!