ঘটনা, দুর্ঘটনা, অর্জন, বিয়োগ, সাফল্য আর ব্যর্থতা মুড়িয়ে বিদায় হয়েছে ২০২৩ সাল। ইতিবাচক-নেতবিাচক বিভিন্ন দিক থেকেই ২০২৩ সাল স্মরণে রাখার মতো। বিদায়ী বছরে উদ্যম আর সু-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করেছেন অনেকে।
অনেক যুবক চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হয়েছেন। কর্মস্পৃহাকে কাজে লাগিয়ে তারা হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। তাদের সফলতার গল্প নিয়ে আজকের সালতামামির আয়োজন।
চার তরুণের ‘সবজিগ্রামে’ কৃষক পাচ্ছেন বাড়তি দাম
করোনাকালের ‘ঘরবন্দী’ সময়ে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করেন চার তরুণ। কয়েক মাসের আলাপ–আলোচনার পর প্রাথমিকভাবে শাকসবজি বিপণনের সিদ্ধান্ত নেন তারা। তারপর বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন চার তরুণ।
গত বছরের মার্চ মাসে হেমায়েতপুরে পাঁচ হাজার বর্গফুটের একটি ওয়্যারহাউস (গুদাম), একটি ট্রাক আর কয়েকজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ‘সবজিগ্রাম’–এর।
বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ও যশোর থেকে প্রতিদিন ৩ টন সবজি ঢাকার উত্তরা, বনানী, মহাখালী, মিরপুর-৬ ও শ্যামলী কাঁচাবাজারের প্রায় অর্ধশত খুচরা সবজি বিক্রেতাকে সরবরাহ করে থাকে এই ‘সবজিগ্রাম’। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই সবজির সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে যায় সাড়ে ৪ থেকে ৫ টন। পাশাপাশি স্বনামধন্য একটি অনলাইন সুপারশপে প্রায় ১০০ ধরনের সবজি সরবরাহ করে চার তরুণের এ প্রতিষ্ঠান। এসব সবজি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা।
বর্তমানে প্রায় শতাধিক কৃষক সবজিগ্রামে শাকসবজি সরবরাহ করেন। যদিও প্রায় দেড় হাজার কৃষকের সঙ্গে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সবজিগ্রামে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৩৫।
অ্যাম্বুলেন্সচালক থেকে সফল মাল্টা চাষি হুমায়ুন
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের হুমায়ুন কবির। পেশায় ছিলেন অ্যাম্বুলেন্স চালক। রোগী নিয়ে যেতেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। একবার এক রোগী নিয়ে গিয়েছিলেন বরিশালে। সেখানে তার নজরে পড়ে এক মাল্টা বাগান। সেই বাগান দেখেই তার ইচ্ছা জাগে মাল্টা চাষ করার। সে চিন্তাই বদলে দেয় হুমায়ুন কবিরের জীবন। তিনি এখন সফল এক মাল্টাচাষি।
বিভিন্ন জায়গা থেকে মাল্টা চারা সংগ্রহ করে জমি লিজ নিয়ে বাগান করেন হুমায়ুন। অল্প কিছু গাছে মাল্টা থেকে ভালো আয় হওয়ার পর ১১ বিঘা জমি নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাল্টা বাগান করে ফেলেন তিনি। দুই বছরে ভালো ফলন পাওয়ায় ও লাভবান হওয়ায় মাল্টা বাগান আরও বড় করার আশা প্রকাশ করেন তিনি। বারি-১, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ও ভিয়েতনামের ইয়ালো জাতের মাল্টা রয়েছে হুমায়ুনের বাগানে।
গারো পাহাড়ে আনারস চাষে সফল পিটার
শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড়ের পতিত জমিতে বাণিজ্যিকভাবে সুমিষ্ট জাতের আনারস চাষ করে সফল হয়েছেন পিটার সাংমা নামের এক গারো আদিবাসী।
পিটার সাংমা জানান, প্রায় দেড় বছর আগে টাঙ্গাইলের মধুপুর থেকে ঝিনাইগাতী এসে তিনি শ্বশুরের ১৮ বিঘা জমিতে প্রায় সোয়া লাখ আনারসের চারা রোপণ করেন। এবার ওইসব চারা থেকে এক লাখ ১০ হাজার গাছে আনারসের ফলন হয়। এসব ফল মধুপুরের এক ব্যবসায়ীর কাছে ১৬ লাখ টাকায় বিক্রিও করেছেন। এ ছাড়া বাগানে আরও প্রায় তিন লাখ টাকার আনারস বিক্রি করার উপযোগী হয়েছে।
ইউটিউব দেখে ‘সাম্মাম’ চাষ করে সফল তরিকুল
বরগুনার উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটায় মধ্যপ্রাচ্যের ফল সাম্মাম চাষ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তরিকুল ইসলাম নামের এক শিক্ষক।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সাম্মাম ফল বেশ জনপ্রিয়। ফলটি দেখতে অনেকটা দেশীয় ফল বাঙ্গির মতো। এর ইংরেজি নাম রকমেলন, খেতে খুবই মিষ্টি, রসালো ও সুগন্ধযুক্ত। প্রতিটির ওজন প্রায় দুই থেকে আড়াই কেজি। জমিতে রোপণের দেড় মাসের মধ্যেই গাছে ফল আসতে শুরু করে। তিন মাসের মধ্যেই পরিপক্ক হয়। এ ফলের তেমন একটা রোগবালাই নেই। এছাড়া খুবই সামান্য সার ও কীটনাশক ব্যবহার করলেই হয়।
তরিকুল ইসলাম বলেন, “আমি ইউটিউব দেখে রংপুর থেকে সাম্মামের বীজ সংগ্রহ করেছি। প্রথম দিকে অনেকেই বলেছেন পাথরঘাটায় এই ফল হবে না। কিন্তু আমি সাহস করে চাষ করেছি এবং সফল হয়েছি। প্রতি কেজি সাম্মাম ১০০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। একেকটি সাম্মামের ওজন আধা কেজি থেকে ২ কেজি পর্যন্ত। তরমুজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। একেকটির ওজন আধা কেজি থেকে ৩ কেজি। এ ফল খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছি।”
মুক্তা চাষে সফল দুই ভাই
ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের দুই ভাই জিহাদ (২৬) ও জাহিদ (২৪)। ইউটিউবে ভিডিও দেখে মুক্তা চাষের উদ্যোগ নেন তারা। বর্তমানে তাদের চাষ করা মুক্তা বাজারে বিক্রির উপযোগী হয়ে উঠেছে। তাদের এ সফলতা দেখে এলাকার অনেক বেকার যুবক মুক্তা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
জিহাদ ও জাহিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ সালে তারা ইউটিউব দেখে মুক্তা চাষে আগ্রহী হন। এরপর ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে নওগাঁ থেকে ঝিনুক ও মুক্তার ডিজাইন এনে বাড়ির পাশের পুকুরে মুক্তা চাষ শুরু করেন। প্রথমে এক হাজার ঝিনুক ও মুক্তার ডিজাইন এনে ৩৫টি খাঁচায় ভরে পুকুরে ছাড়েন। এতে সবমিলে ৬৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি পিস মুক্তার পাইকারি বাজার দর দুই থেকে আড়াইশ টাকা। বিক্রি উপযোগী মুক্তার বাজার মূল্য আনুমানিক ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা হতে পারে।
এদিকে দুই ভাইয়ের মুক্তা চাষ দেখতে প্রতিদিনই খামারে স্থানীয় বেকার যুবকরা ভিড় জমাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে অনেকেই মুক্তা চাষ শুরু করেছেন।
বাড়ির আঙিনায় মাল্টা চাষে সফল কাজী কামাল
মাল্টা পাহাড়ি ফল হিসেবে পরিচিত হলেও সমতল ভূমিতেও রয়েছে এ ফলের ব্যাপক সম্ভাবনা। কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় বাড়ির আঙিনায় মাল্টা চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন কাজী কামাল উদ্দিন। তিনি তিতাস উপজেলার ৫ নম্বর কলাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব হিসেবে কর্মরত। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনা উপজেলার কাশিপুর হলেও চাকরি করার সুবাদে তিতাস উপজেলায় সপরিবার বসবাস করছেন তিনি।
জানা যায়, প্রায় দুই বছর আগে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ৪৫টি মাল্টার চারা এনে বাড়ির আঙিনায় ২০ শতাংশ জায়গার মধ্যে মাল্টা চাষ শুরু করেন কামাল উদ্দিন। প্রথম বছর অল্প পরিমাণ মাল্টার ফলন হলেও এ বছর প্রতিটি গাছে ৪০-৫০টি করে মাল্টা ঝুলছে। এতে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারেও বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। এ ছাড়া বাড়িটিতে রয়েছে কমলা, লেবু, পেঁপে, ড্রাগন, পেয়ারা, সফেদা, মরিচ, এলাচ, দারচিনি, করমচা, বেলেম্বো, কাঁঠাল, নারকেল, আমড়া, ল্যাংড়া ও আম্রপালি আমসহ প্রায় ২৫ ধরনের নানা প্রজাতির ফল গাছ।
প্রসঙ্গত, উপরে বর্ণিত ব্যাক্তিদের সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প এখন বেকারত্ব নিরসনে অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেরকে অনুসরণ করে সাবলম্বী হচ্ছেন এখন অনেকেই।