পৌষ মাসের শেষ সময়। তীব্র শীতে জবুথবু রাজধানী। কমেছে দিন ও রাতের তাপমাত্রা। সারা দিনে ঘণ্টাখানেকের মতো সূর্যের দেখা মিলেছে। ছিল কুয়াশা ভাব, সেই সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস। কনকনে ঠান্ডা আর হিমেল হাওয়ায় দাপটে ওঠানামা করছে পারদ। এমন অবস্থায় সারা দেশেই দিনের তাপমাত্রা কমেছে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা নেমেছে ১০ ডিগ্রিরও নীচে। সব অঞ্চলেই জেঁকে বসেছে শীত।
দিনাজপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, নীলফামারী, সৈয়দপুর ও গোপালগঞ্জ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর বলছে, শীতের কারণে মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছেন। শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে। ওদিকে হাসপাতালে শিশু ও প্রবীণ রোগীর ভিড় বাড়ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এমন অবস্থা বিরাজ করবে আরও দুই থেকে তিন দিন। তবে এরপরেও স্বস্তি নেই। ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি আকাশ মেঘলা থাকবে। বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টির পর আবার তীব্র শীত নামবে। মাসের বাকি সময় থাকতে পারে তীব্র শীত। এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, সিলেট, যশোর ও চুয়াডাঙ্গাজুড়ে বয়ে যেতে পারে শৈত্যপ্রবাহ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, শীতের এই অবস্থা আরও দুই থেকে তিন দিন থাকতে পারে। ১৮ জানুয়ারির পরে সারা দেশেই হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর আর একটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে।
তবে এই আবহাওয়াবিদ জানান, জানুয়ারি মাস অনুযায়ী তাপমাত্রা খুব বেশি কমেনি। বাতাসের কারণে শীতের অনুভূতি বেশি হচ্ছে। এই সময়ে এমন ঠান্ডা স্বাভাবিক ঘটনা।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সারা দেশে তীব্র শীতের প্রধান কারণ শৈত্যপ্রবাহ নয়। মূল কারণ হলো দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়া। অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এলে শীত বেশি লাগে। দিনে সূর্যের আলো কম আসায় দিন ও রাতের তাপমাত্রা ওঠানামা করে না। ফলে ওই দুই বিপরীতধর্মী সময়ে শীতের অনুভূতি বেড়ে যায়। আগামী দুই-তিন দিন শীতের অনুভূতি বেশি থাকতে পারে।
গ্রামাঞ্চলে তীব্র শীতে কষ্ট পাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় অনেকেই খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। এদিকে হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় শীতের তীব্রতায় সবচেয়ে বেশি ভুগছেন উত্তরের মানুষ। ঘন কুয়াশায় দেখা যায়নি সূর্যের আলো। উত্তরের জেলাগুলোতে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে ছিন্নমূল, অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা। ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে।
শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছে গরম কাপড়ের বাজার। অনেকেই পরিবারের জন্য, আবার কেউ কেউ ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করতে এখন গরম কাপড় কিনছেন। রাজধানীর বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান ও নিউমার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে হরতাল ও অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে পাইকারি বেচাকেনায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তারা। তবে শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রয়াদেশ বেড়েছে। শীতের শুরুতে ত্রাণের কম্বলেরও চাহিদা কম ছিল।
দেশে গতকাল শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল কিশোরগঞ্জের নিকলীতে, ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ ছিল টেকনাফে ২৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজধানীতে সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ১৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।
রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ রংপুরে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য মাত্র আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা জুড়ে একই ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতি রয়েছে। ফলে এসব এলাকায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার দাড়িয়াপুর হাটে গিয়ে গতকাল বিকেলে দেখা যায়, মানুষ হাটের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন। যাতায়াত কমে যাওয়ায় পরিবহনশ্রমিকের আয় কমে গেছে। খোলাহাটি গ্রামের রিকশাচালক ভুট্টু মিয়া (৪৮) বলেন, দিনে তাঁর আয় ৪০০ টাকার মতো। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকা।
তীব্র শীতে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে। যেমন চুয়াডাঙ্গার ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ছুটির দিনে বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন। হাসপাতালের শিশু ও মেডিসিন ওয়ার্ডে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি রোগী ছিলেন।
শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে গতকাল সকালে দেখা যায়, ১৪টি শয্যার বিপরীতে ৪৬টি শিশু চিকিৎসাধীন। সেখানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এক বছর বয়সী শিশু আবদুল্লাহকে নিজ হাতেই ‘নেবুলাইজার’ দিচ্ছিলেন মা শেফালী খাতুন। তিনি বলেন, শীতে সন্তানের ঠান্ডা লেগে গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শনিবারও সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা থাকবে। ফলে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িক বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিশোরগঞ্জ, পাবনা, দিনাজপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় যে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে।