রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা। নগরীর ব্যস্ততম এই এলাকার অনেক রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হয়েছে রাজা-বাদশাহর নামে। তবে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সলিমুল্লাহর নামে। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কটির নামকরণ করা হলেও এই তথ্যটি এখনো অনেকের অজানা।
এলাকাবাসীর অনেকেই ভেবে বসেন এই সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নামে। ফলে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে এর নামকরণের ইতিহাস। আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পথের টাউনহল পেরুলেই চোখে পড়বে সড়কটি।
সরেজিমেন দেখা যায়, সড়কের আশপাশের দোকানগুলোর পরিচিতি পর্বের (সাইনবোর্ড) অধিকাংশ স্থানেই শহীদ শব্দটি লেখা নেই। শুধু তাই নয়, সিটি করপোরেশনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলকেও লেখা হয়নি শহীদ শব্দটি। তবে আশপাশের দোকানগুলোর পুরাতন কিছু সাইনবোর্ডে শহীদ সলিমউল্লাহ সড়ক লেখা রয়েছে।
জানা যায়, শহীদ মো. সলিমুল্লাহ ছিলেন মোহাম্মদপুরের বাঙালিদের একজন নেতা এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের দুই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সাদী মহম্মদ ও শিবলী মহম্মদের বাবা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনই মোহাম্মদপুরের নিজ বাড়িতে খুন হন তিনি।
পাকিস্তান আমলে ‘শহীদ সলিমউল্লাহ সড়কের’ নাম ছিল ‘কায়েদে আজম’ রোড। সলিমউল্লাহ শহীদ হলে এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে সড়কটির নাম পরিবর্তন করে শহীদ সলিমউল্লাহ নামকরণ করে মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। পরে তা সরকারিভাবে স্বীকৃতিও পায়।
শহীদ শব্দটি না লেখায়, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শহীদ সলিমউল্লাহ সন্তান ও প্রখ্যাত নৃত্য শিল্পী শিবলী মুহম্মদ।
এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় এক কাপড় ব্যবসায়ী রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে। তার দোকানে শহীদ শব্দটি না লেখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শহীদ না লেখার পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই। তবে লিখলে ভালো হতো। যদিও এই রোডের নামকরণের সঠিক ইতিহাস আমি জানি না।”
স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম বলেন, “অনেকেই ভাবেন নবাবের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, আবার অনেকেই ভাবেন শহীদ সলিমউল্লাহর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এর সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
মো. শামীম নামের এক বৃদ্ধ বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সলিমউল্লাহ সাহেব শহীদ হোন। পরের বছর তার নামে এই সড়কের নাম করা হয়। এর আগে কায়েদি আজম রোড নাম ছিল। শহীদ সলিমউল্লাহ সাহেব চাঁদপুরের বাসিন্দা ছিলেন এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় তার প্রথম চার তলা বাড়ি ছিল।”
কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী রাত্রি দাস বৃষ্টি বলেন, “বাংলাদেশের অনেক স্থানের নামকরণের সঠিক ইতিহাস আমরা জানি না। সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা জরুরি। তাহলে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারব।”
শহীদ সলিমুল্লাহর সন্তান ও নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমার বাবাকে আমাদেরই সামনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরে আমার বাবার নামে এখানকার বাঙালিরা এবং সরকার মিলে এই সড়কের নাম করণ করেন। কিন্তু অনেকেই এই নামকরণের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন।”
শিবলী মহম্মদ বলেন, “পূর্বে মোহাম্মদপুরের অধিকাংশ রোড ছিল ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নামের। যেমন, আওরঙ্গজেব রোড, তাজমহল রোড, বাবর রোড। শুধু এই রোডের নাম ছিল কায়েদি আজম, যিনি পাকিস্তানিদের জাতির পিতা ছিলেন। আমার বাবা শহীদ হওয়ার পর আমার মা অনেক কষ্ট করেছেন। পরে যখন বাবার নামে রোডের নাম হলো, অনেকটা প্রশান্তি পেয়েছি। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ স্থানেই লেখা হয় সলিমউল্লাহ রোড। শহীদ শব্দটি নেই। সিটি করপোরেশনের নাম ফলকেও শহীদ কথাটি লেখা নেই।”
শিবলী মহম্মদ আরও বলেন, “শহীদ কথাটি না লেখাতে অনেক কষ্ট পাই। মনে হয়, এখনো দেশে পাকিস্তানি প্রেমীরা রয়ে গেছেন। তাদের কাছে মনে হয় কায়েদি আজম নাম থাকলেই ভালো হতো। আমি বলব, বলার সময় সলিমউল্লাহ বলেন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লেখার সময় অন্তত শহীদ কথাটি লিখেন। এতে সঠিক ইতিহাসের দলিলটা ঠিক থাকবে।”