ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রমিক দল নেতাদের ফরমায়েশি তালিকা মেনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, পদোন্নতি বা দায়িত্বে রদবদল করার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ভালো জায়গায় বদলির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, কাউকে–বা খারাপ জায়গায় বদলির হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সংস্থাটিতে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
শনিবার (২৬ অক্টোবর) সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইনে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা শেখ অহিদুজ্জামান। ডিএনসিসির অঞ্চল-২–এর পৌরকর শাখার (গৃহকর) উপ–কর কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। গত ২৬ সেপ্টেম্বরের অফিস আদেশে ওই দায়িত্বসহ তাকে একই অঞ্চলের কর কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে এ দায়িত্ব দিতে সেখানকার কর কর্মকর্তা এ এফ এম জোবায়ের ইসলাম ভূঁইয়াকে অঞ্চল-৭–এ বদলি করা হয়। কিন্তু ওই অঞ্চলে গৃহকর আদায়ের কার্যক্রম পুরোদমে শুরুই হয়নি।
তবে শুধু অহিদুজ্জামানের দায়িত্বে রদবদল করলে তার চেয়ে জ্যেষ্ঠ অপর তিন উপ–কর কর্মকর্তার সঙ্গে ‘অন্যায়’ করা হচ্ছিল। তাই তাদেরও কর কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে যুবরাজ দেবনাথ ও আবদুল আজিজকে দেওয়া হয় অঞ্চল-৮–এর পৌরকর (গৃহকর) ও বিবিধ (ট্রেড লাইসেন্স) শাখার কর কর্মকর্তার দায়িত্ব। এখানেও অঞ্চল-৭–এর মতো অবস্থা। আর মাহবুব আলমকে দেওয়া হয় অঞ্চল-২–এর কর কর্মকর্তার (বিবিধ আদায় শাখা) দায়িত্ব।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (শ্রমিক দল) থেকে ডিএনসিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বদলির ফরমাশ দিয়ে দুই দফা তালিকা দেওয়া হয়েছিল। এর একটিতে অহিদুজ্জামানের নাম ছিল এক নম্বরে। সেই ফরমাশ অনুযায়ীই অহিদুজ্জামানকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ওই পদে দেওয়া হয়েছে।
শেখ অহিদুজ্জামান বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করেছে, আমাকে দায়িত্ব দিলে রাজস্ব আদায় বাড়বে, সে অনুযায়ী আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে।”
তালিকা দিয়ে বদলির ফরমাশ করা বিষয়ে ডিএনসিসির শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, “১৭ বছর ধরে অনেক অযোগ্য লোক শ্রমিক লীগের রাজনীতি করে বিভিন্ন পদ দখল করে রেখেছিলেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে একই দায়িত্বে ছিলেন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনেকে যোগ্যতা থাকার পরও এত দিন উপেক্ষিত ছিলেন। আমাদের পক্ষ থেকে এমন যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে সুপারিশ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এখানে শ্রমিক দলের রাজনীতির বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে না।”
৫৯ জনের বিষয়ে বদলির তালিকা
উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিক দলের নেতা-কর্মীরা ৫ আগস্টের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাকে, কোন এলাকায়, এমনকি কোন পদে বদলি কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে হবে—এমন ফরমাশ তৈরি করে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবের দপ্তরে দুটি তালিকা দেন। প্রথম তালিকায় ১৭ জন ও দ্বিতীয় তালিকায় ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম ছিল।
দুই তালিকায় থাকা ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ইতিমধ্যে ১৮ জনকে বদলি বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শ্রমিক দলের রাজনীতিতে যুক্ত বা সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের ভালো এলাকা বা পদে পাঠানো হয়েছে।
গত ২৭ আগস্ট থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৮৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সহকারী সচিব রাকিবুল হাসান এক বছরের কম সময় ডিএনসিসি অঞ্চল-৪ এর কর কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। শ্রমিক দলের দেওয়া প্রথম তালিকায় তার নাম ছিল। ২৮ আগস্টের এক আদেশে তাঁকে অঞ্চল-৬ ও ৮–এর কর কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। অঞ্চল দুটিতে কর আদায় কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি।
বদলি হওয়া এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শ্রমিক দল যেভাবে চাইছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে বদলির আদেশ করছে।
ভালো জায়গায় শ্রমিক দলের নেতারা
সম্প্রতি ডিএনসিসিতে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের ২৬ সদস্যের একটি শাখা কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কমিটির সাত নেতাকে আগের চেয়ে ভালো পদে বদলি বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আরও অন্তত পাঁচজনের বদলির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অন্য নেতারা আগে থেকেই তুলনামূলক ভালো পদে দায়িত্বে থাকায় তাঁদের বদলি করা হচ্ছে না।
বদলি হওয়া ব্যক্তিদের একজন ওই কমিটির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল করিম। গত ৯ সেপ্টেম্বর অঞ্চল-৫–এর ভ্যাকসিনেটর রাবেয়া আক্তারকে সরিয়ে তাঁকে ওই পদে বদলি করা হয়। ১৭ অক্টোবর তাকেই আবার ওই দায়িত্বসহ প্রকৌশল বিভাগের কার্যসহকারী করা হয়। এ জন্য ওই পদ থেকে সরানো হয় শ্রমিক লীগের ডিএনসিসি শাখার সহসাধারণ সম্পাদক নুর হোসেনকে।
শ্রমিক দলের কমিটির সহসভাপতি শেখ শওকত হোসেনকেও বদলি করে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি নগর ভবনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বেঞ্চ সহকারী ছিলেন। ২৭ আগস্ট তাঁকে অঞ্চল-৩–এর লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
‘প্রশাসনিক স্বার্থেই’বদলি
উত্তর সিটির ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, শ্রমিক দল কিছু তালিকা দিয়েছে, কিছু মৌখিকভাবেও প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই বদলির আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে প্রশাসনিক স্বার্থেই।
তবে এ বিষয়ে উত্তর সিটির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, “শ্রমিক দলের তালিকা ধরে কোনো বদলি হচ্ছে না। আমাদের পরিকল্পনা ও তাঁদের চাওয়া মিলে যাচ্ছে। সে কারণেই এমন মনে হচ্ছে।”
বদলিকে একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, তারা (শ্রমিক দল) দাবি করতেই পারে। সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে যেটা প্রশাসনিকভাবে যথাযথ এবং আইনসম্মত, সে সিদ্ধান্তই নেওয়া হচ্ছে।
অনৈতিক লেনদেন ও কর্মীদের আতঙ্কের বিষয়ে মীর খায়রুল আলম বলেন, লেনদেনের খবর বিভিন্নভাবে আসে। অনেক অনুরোধে অর্থনৈতিক বিষয় থাকে। অর্থের বিনিময়ে বদলি যে বা যারাই করবে, কোনোভাবে সহ্য করা হবে না। আর কারও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।