• ঢাকা
  • বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শোভনের শেষ কথা, ‘একটু হাসপাতালে নিয়ে যান, প্লিজ’


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪, ১২:১২ পিএম
শোভনের শেষ কথা, ‘একটু হাসপাতালে নিয়ে যান, প্লিজ’

রাজধানীর চকবাজারের বিক্রয় প্রতিনিধি আলমগীর হোসেন। তার দুই বন্ধুকে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯ জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশের গুলিতে শোভন গুলিবিদ্ধ হন। 

২০২৩ সালে শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন শোভন। তার জাপানে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। তার আগেই তিনি চলে গেছেন।

আলমগীর বলেন, “নিউমার্কেটের পেট্রোল পাম্পের সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছিল। গুলির আওয়াজ আর ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলছিল। পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটি ছেলে সেজদার ভঙ্গিতে বসে আছে। পুলিশ আমাদের সামনে চলে গেছে। দ্রুত ছেলেটির কাছে গিয়ে তাকে ধরে বললাম, ‘ভাই, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যান, প্লিজ।’ এই কথা বলার পরই ছেলেটি আমার হাতের ওপর পড়ল।”

তিনি বলেন, “আমরা দ্রুত একটি রিকশা নিলাম। তখনো ছেলেটি বেঁচেছিল। তার ফোন আনলক করে আমরা তার আইডি কার্ড দেখে পেলাম, নাম: ‘সাইদুল ইসলাম শোভন, কলেজ শেখ বোরহানউদ্দিন’। তার ফোন থেকে একটি নম্বরে কল করে জানালাম, শোভনের গুলি লেগেছে এবং তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হচ্ছে। তার পরিবারের কাছে খবর পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হোক।”

আলমগীর বলেন, রাস্তায় শোভন এক বড় নিঃশ্বাস নিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, হয়তো সে মারা যাবে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর দেখি, আহত ও নিহতদের ভিড়। চারপাশে কান্নাকাটি আর হুড়োহুড়ি। একজন ডাক্তার এসে বললেন, ‘এখনই মারা গেছে।’ 

শোভনের মা শাহনাজ বেগম বললেন, “সেদিন শুক্রবার ছিল। শোভন দুপুরে বিরিয়ানি খাচ্ছিল, তার বন্ধুরা বারবার ফোন দিচ্ছিল। ছেলেটা তাড়াহুড়ো করে খেয়ে চলে গেলো। আমি জানতাম না, এটি তার শেষ খাবার হবে।”

সন্ধ্যায় পাশের বাড়ির একটি ছেলে এসে শাহনাজ বেগমকে  বলল, ‘আন্টি, শোভনের গুলি লেগেছে। ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’  শোভনের বাবা তখন ভারতে। 

কাঁদতে কাঁদতে শাহনাজ বলেন, “আমি পাগলের মতো হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি, ইমার্জেন্সির এক কোনায় ট্রলিতে শোভন পড়ে আছে। আমি তাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁকুনি দিলাম, কিন্তু আমার ছেলেটি আর কোনো সাড়া দিলো না। ‘আমার শোভন আর নেই!’” 

তিনি বলেন, “আমরা ভয় পাচ্ছিলাম, পুলিশ যদি লাশ নিয়ে যায় বা আমাদের আটক করে। তাই ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাড়াহুড়া করে ভাই ও বন্ধুরা সহযোগিতা করে হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে আসলাম।”

কিছু বছর আগে, ২১ ফেব্রুয়ারি শোভন ক্লাস সেভেনে বা এইটে পড়ত। তিনি একটি পোস্টার বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। পোস্টারটিতে ভাষা শহীদদের ছবি ছিল এবং শোভনের নিজের ছবি ছিল। 

শোভনের মা বলেন, এখন সেই পোস্টারের সব চরিত্র শহীদ হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা কি শোভনের ভাগ্যে শাহাদাত লেখা রেখেছিলেন?

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতাম না, আমার ছেলে দেশের জন্য এতটা ভালোবাসা রাখতো। সে নিজেই দেশের জন্য শহীদ হয়ে গেল!’

শোভনের বাবা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সব কিছু শেষ হয়ে গেল। জানি না, বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাব।”

তিনি বলেন, “সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার নেই। শোভন দেশের জন্য যে স্বপ্ন নিয়ে মারা গেছে, দেশের উন্নতি হোক। দেশ যেন শোভনের আত্মত্যাগ ভুলে না যায়।”

বোরহানউদ্দিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন বলেন, “শোভন ছিল সাহসী, আমাদের জাতীয় বীর। তার আত্মত্যাগ এই দেশের নতুন যুগের সূচনা করেছে। আমরা এই বীরদের অবদান ভুলব না।”

তিনি আরও বলেন, “শোভনের স্মরণে চান খার পুল চত্বরকে ‘শোভন চত্বর’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। শোভন সবার জন্য অনুকরণীয়। সবাই তার জন্য দোয়া করুন। আল্লাহ যেন শোভনকে জান্নাত দেন।”

Link copied!