ঘন কুয়াশাছন্ন সকাল। কুয়াশার পাশাপাশি শীতের তীব্রতাও ছিল বেশি। পাঞ্জাবি আর কালো চাদর গায়ে দিয়ে উত্তরার আজমপুরে যাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন ইদ্রিস আলম ভাই। কনকনে শীত আর সঙ্গে হিমশীতল বাতাসে অনেকটাই কাবু হওয়ার মতো অবস্থা আমাদের। শীত নিবারণের চেষ্টায় সড়কে অসহায় ও পথশিশুরা উষ্ণতার খোঁজে আগুন পোহাচ্ছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে পার হয়ে দলিপাড়া যেতেই সামনে রাস্তার ওপর দুই থেকে তিনটি শিমুল ফুলের দেখা মেলে। ইট-পাথরের দালানকোঠার মাঝে শিমুল ফুল!
দলিপাড়া সড়কে যেতেই পাশে ছোট-বড় কয়েকটি আমগাছের মাঝে ধুলায় মিশ্রিত মোটা একটি গাছের দেখা মেলে। মূলত সেটিই শিমুলগাছ। বিশালাকার গাছে শোভা পেয়েছে নয়নাভিরাম শিমুল ফুল। আশপাশে ইটের তৈরি বড় বড় দালানকোঠার মধ্যেও প্রকৃতিকে যেন সাজিয়েছে শিমুলে ফুলের শোভায় এক নতুন রূপে। বাতাসে দোল খাচ্ছে ফুলের রক্তিম আভায়। গাছের ডালে ফুটে থাকা শিমুল ফুলে মানুষের মনকে যেন রাঙিয়ে তুলেছে।
প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য মনে করিয়ে দেয় শাহ আবদুল করিমের সেই গানের লাইনটি “বসন্ত বাতাসে সেই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে, সেই গো বসন্ত বাতাসে।"
শিমুলগাছের এমন অপরূপ সৌন্দর্য এখানকার স্থানীয়দের কাছে খুব বেশি পরিচিত হলেও বড় বড় দালানকোঠায় বসবাস করা লোকের কাছে ঢাকায় শিমুলগাছ দেখা ভাগ্যের বিষয় বটে। কারণ, নগর উন্নয়নে সবুজ প্রকৃতি ধ্বংসের যে নীলা চলছে, তা অচিরেই বন্ধ না হলে একটি আমগাছ দেখাও শহরবাসীর জন্য ভাগ্য হয়ে দাঁড়াবে।
দলিপাড়ার এই ছোট সড়ক দিয়ে উত্তরার বাউনিয়া থেকে রাজলক্ষ্মীর নিয়মিত পথিক রাজিবুল হক। সকালে মার্কেটে যান রাতে বাসায় ফিরেন। শিমুল ফুলের এমন সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ তিনি। জানালেন মুগ্ধতার কথা। তিনি বলেন, "যান্ত্রিক এই শহরে শব্দ, ধুলা, ব্যস্ততা ছাড়া কিছু নেই। যা সবুজ অরণ্য ছিল সেটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে নগর উন্নয়নে।"
তিনি আরও বলেন, "লাল রক্তিম শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে ফুলের দিকে তাকালে মন ভরে যায়। মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। ছোটবেলায় মনে পড়ে শিমুল ফুল পেড়ে কাঁঠালের পাতাকে টাকা ভেবে বিক্রি করার কথা। কালের বিবর্তনে সেই সব স্মৃতি বর্তমান প্রজন্মের কাছে মৌখিক গল্প হয়ে থাকবে।"
রাজিবুল হক বলেন, "আমি যত দিন এই সড়ক দিয়ে গেছি তত দিন এই শিমুলগাছ দেখেছি। গাছ দেখে আন্দাজ করা মুশকিল গাছের বয়স কত। তবে ফুলে ভড়া শিমুলগাছ থেকে সত্যিই আমি মুগ্ধ।"
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরার বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুলগাছের বয়স ৩০-৩৫ বছর। গাছের মালিক সাংবাদিক রাসেল খানের পরিবার। তার দাদার বাবা মরহুম মো. মক্রম হোসেন খান এ গাছ লাগান। তবে পরিচর্যার গাছ রাসেল খান নিজেই করেন।
রাসেল খান বলেন, "আমাদের এই গাছের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছর হবে। আমার দাদা মুলফত হোসেন খানের বাবা মক্রম হোসেন খান গাছটি লাগিয়ে গেছেন।"
গাছ না কাটার কারণ হিসেবে তিনি বলেন,“শিমুলগাছ সুন্দর। পরিবেশের সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি করে। সবাইকে ছায়া দিয়ে থাকে। দেখতেও খুব সুন্দর দেখায়। আর বিশেষ করে এই গাছ গাঠ গাছ না। যদি কাঠ গাছ হতো তাহলে একটা পর্যায়ে গিয়ে বিক্রি করা যেত। যেহেতু কাঠ গাছ না, সেহেতু কাটার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই মনে করি।”
রাসেল খান বলেন,“আস্তে আস্তে দেশ থেকে গাছপালা কাটার কারণে অক্সিজেনশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সবার উচিত পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানো।”
শিমুলগাছ রাখার বিষয়ে রাসেল খান আরও বলেন,“গাছ রাখা আসলে এটা সময়ের ব্যাপার। গাছটি যদি কখনো ভেঙে না পড়ে তাহলে কাটার কোনো চিন্তাভাবনা নেই। কারণ সে জায়গাটি আমাদের ব্যবহার করা হয় না। যেহেতু এটা প্রাচীনতম গাছ সেতু এটা কাটার পক্ষে আমরা না।”
টকটকে লাল রঙের এই ফুলের গন্ধ নেই। তবে প্রকৃতিকে বিমোহিত করে রাঙিয়ে তোলে তার রূপলাবণ্য দিয়ে। গ্রামবাংলার মানুষ ক্যালেন্ডারের তারিখ গণনা করতে না পারলেও শিমুলগাছে ফুল এলেই বলতে পারে এখন ফাল্গুন মাস এসেছে। গাঢ় লাল রঙের পাপড়ি আর সবুজ রঙের বোঁটায় শোভিত এক অপরূপ ফুলের নাম শিমুল। কিছুদিন পরে রক্তলাল থেকে সাদা ধূসর হয়ে তৈরি হবে তুলা। সেই তুলা বাতাসে ভেসে ভেসে দোলা দেবে বসন্তের গায় ও শিমুলের বনে।