• ঢাকা
  • রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

মডেলিংয়ের নামে তরুণীদের দিয়ে যৌন ব্যবসা, ৭ বছরে আয় শতকোটি টাকা


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৪, ০৬:৪৭ পিএম
মডেলিংয়ের নামে তরুণীদের দিয়ে যৌন ব্যবসা, ৭ বছরে আয় শতকোটি টাকা

আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি, ট্যালেন্ট হান্ট ও মডেলিংয়ের কথা বলে উঠতি বয়সী তরুণীদের দিয়ে যৌন ব্যবসা করানোর অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার।

মঙ্গলবার (২৫ জুন) বিভিন্ন সময়ে রাজধানী ঢাকা, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর ও যশোরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এসময় গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে পর্নোগ্রাফি তৈরি ও তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল করায় ব্যবহৃত ১২টি মোবাইল ফোন, ২০টি সিম কার্ড, ১টি ল্যাপটপ এবং আয়ের টাকা লেনদেনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও চেক বই জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তাররা হলেন- চক্রের প্রধান ও মেডিকেল শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসান (২৫), তার প্রধান সহযোগী খালাতো ভাই শেখ জাহিদ বিন সুজন (২৬), অন্য সহযোগী মো. জাহিদ হাসান কাঁকন (২৮), তানভীর আহমেদ ওরফে দীপ্ত (২৬), সৈয়দ হাসিবুর রহমান (২৭), শাদাত আল মুইজ (২৯), সুস্মিতা আক্তার ওরফে পপি (২৭) ও নায়না ইসলাম (২৪)।

পুলিশ জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে অতি কৌশলে শতশত তরুণীকে ফাঁদে ফেলে আধুনিক যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করছেন তারা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যেমন টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, তেমনি তাদের ভিডিও টেলিগ্রাম গ্রুপে শেয়ার করা হয়। সেখানে থাকা থাকা লাখ লাখ দেশি-বিদেশি সাবস্ক্রাইবারদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় টাকা। এভাবে চক্রটি গত সাত বছরে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা।

বুধবার (২৬ জুন) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত সিআইডির সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এসব তথ্য জানিয়েছেন।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, একটি চক্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া নামে ফেসবুক আইডি ও পেইজ খুলে ফ্রিল্যান্সিং কাজ, লোভনীয় চাকরি, মডেল বানানো, মেধা অন্বেষণের নামে অল্প বয়সী তরুণীদের কাছ থেকে কৌশলে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নেয়। এরপর ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে জোরপূর্বক তাদের দেহব্যবসায় নামানোর ভয়ংকর কার্যক্রম চালায়।

চক্রটি মূলত উঠতি বয়সী তরুণীসহ যেসব তরুণীরা পারিবারিক ভাঙনের শিকার এবং আর্থিকভাবে সমস্যা রয়েছে তাদের টার্গেট করে। কাজের সুযোগ দেওয়ার নামে প্রথমে ইন্টারভিউতে ডাকা হয়। এরপর বিজ্ঞাপনে সুযোগ দেওয়ার কথা বলে আপত্তিকর ছবি নেয়। প্রাথমিকভাবে কাজে আগ্রহী তরুণীদের চাহিদা মতো টাকা ও প্রয়োজন মেটায় তারা। এরপর ধীরে ধীরে অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করে।  

এই চক্রের প্রধান মেহেদী হাসান। তিনি টঙ্গীর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। তার তার খালাতো ভাই শেখ জাহিদ বিন সুজন মিলে এই চক্রটি গড়ে তোলে। শেখ জাহিদ কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী।

তারা চিকিৎসাবিদ্যার আড়ালে অল্প বয়সী তরুণীদের ফাঁদে ফেলে যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট তৈরি ও টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ম্যাসেঞ্জারে অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করে।

এসব অনৈতিক কাজের মাধ্যমে গত ৭ বছরে চক্রটি প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করেছে দাবি করে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এই টাকা দিয়ে তারা যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা এবং ঢাকায় বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় করেছে। নির্মাণ করেছে আলিশান বাড়ি। তাদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও বিপুল অর্থ জমিয়ে রাখার তথ্য মিলেছে।

প্রতারণার ফাঁদ ও নগ্ন ভিডিও তৈরি সম্পর্কে তিনি বলেন, শুরুতে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাকরির বিজ্ঞাপন, মডেল তৈরি ও ট্যালেন্ট হান্ট শীর্ষক প্রতিযোগিতার আয়োজন করত চক্রটি। যারা সাড়া দিত তাদের নিয়ে টেলিগ্রামে গ্রুপ খুলত। তারপর তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে বিদেশি বায়ারদের কাছে পাঠানোর কথা বলে আপত্তিকর ছবি তুলত। সেই সব ছবি ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নগ্ন হয়ে ভিডিও কল বা সরাসরি অসামাজিক কাজে বাধ্য করত।

মোহাম্মদ আলী জানান, চক্রটির নিয়ন্ত্রণে ১০টি টেলিগ্রাম গ্রুপের সন্ধান মিলেছে। এসব টেলিগ্রাম গ্রুপে দেশি-বিদেশি গ্রাহকের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে গ্রাহকেরা ওই গ্রুপগুলোতে যুক্ত থাকত। চক্রটি ভিডিও কলের সবকিছু গোপনে ধারণ করে রাখত। এরপর মেয়েদের বাধ্য করা হতো যৌন সম্পর্ক স্থাপনে। এভাবেই চক্রটির হাতে আধুনিক যৌন দাসিতে পরিণত হয় শত শত তরুণী।

সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপনে ধারণ করা ভিডিও বিক্রি করে চক্রটি প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করেছে। অর্থ লেনদেনের জন্য তারা ব্যবহার করে এমএফএস বা মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস। এছাড়া ক্রিপ্টো কারেন্সিতেও তাদের হাজার হাজার ডলার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের আড়াল করতে তারা বেনামি কয়েকশ মোবাইল সিম ব্যবহার করছিল। যেগুলোর কোনোটিই প্রকৃত ন্যাশনাল আইডি দিয়ে নিবন্ধন করা নয়। নিম্নআয়ের মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সামান্য অর্থ দিয়ে তাদের নামে তোলা হতো সিম কার্ড। কন্টেন্ট আদান-প্রদান ও সাবস্ক্রিপশনের জন্য ছিল টেলিগ্রাম প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন পেইড ক্লাউড সার্ভিস। অল্প বয়সী ভয়ানক চতুর এই দুই মেডিকেল শিক্ষার্থীর কাছে এখনো জিম্মি কয়েক হাজার নারী। এর মধ্যে আছে টিকটক, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম সেলিব্রিটিও।

অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপে গোপনে ধারণ করা প্রায় ১০ লাখ নগ্ন ছবি ও ২০ হাজার অ্যাডাল্ট ভিডিওর সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিঅইডি।

Link copied!