৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে মেঘনা আলম ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, ‘পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক’ তার বাসার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছেন। পরদিন তাকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকের কথা জানায় ডিএমপি। ১০ এপ্রিল পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনাকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন।
এরপর মডেল মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার ঘিরে শুরু হয় আলোচনা। সৌদি রাষ্ট্রদূতের এক অনানুষ্ঠানিক অভিযোগকে কেন্দ্র করে মেঘনার আটক এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। রিমান্ডে বেরিয়ে এসেছে তার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ব্ল্যাকমেল করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন মেঘনা আলম ও তার সহযোগীরা। টার্গেট ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায়ের মূল দায়িত্ব ছিলেন মেঘনা আলমের অন্যতম সহযোগী মানব পাচার চক্রের হোতা মো. দেওয়ান সমীর (৫৮)। এ চক্রের সর্বশেষ টার্গেট ছিলেন সৌদি আরবের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ বিন ঈসা আল দুহাইলান। চক্রটি সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছে ৫ মিলিয়ন (৫০ লাখ) ডলার দাবি করেছিল।
এ ঘটনায় রাজধানীর ভাটারা থানায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেওয়ান সমীর ৫ দিনের রিমান্ডে আছে। ডিএমপির ডিবি হেফাজতে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। এ ছাড়া মেঘনা আলমকে আটকের পর পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি।
মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার-কাণ্ডের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের এক আদেশে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ডিবি প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে মেঘনা আলমের বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করছেন পুলিশের অনেক কর্মকর্তা।
এদিকে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রিমান্ডে দেওয়ান সমীরকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। দেওয়ান সমীর কাওয়ালী নামক প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং সানজানা নামক একটি ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানের মালিক। এই ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার করে আসছেন। এ ছাড়া দেওয়ান সমীরের প্রতারক দলের সদস্যরা বিভিন্ন সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে হাইপ্রোফাইলের ব্যক্তিদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ও অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে। পরে সুকৌশলে বিভিন্ন পন্থায় অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে। এ চক্রটি গত বছরের জানুয়ারি মাসে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ বিন ঈসা আল দুহাইলানকে টার্গেট করে। তার পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয় মডেল মেঘনাকে। তখন থেকেই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নানা কৌশলে সখ্য তৈরি করে মেঘনা। একপর্যায়ে মেঘনা আলম ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন করে ফাঁদে ফেলে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দাবি করেন। এ টাকা তোলার মূল দায়িত্বে ছিলেন দেওয়ান সমীর। সে বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্রদূতকে টাকার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। পরে রাষ্ট্রদূত নিরুপায় হয়ে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তারর দেওয়ান সমীরকে জিজ্ঞাসাবাদে তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। সে জানিয়েছে, সুন্দরী মেয়েদের সহায়তায় হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের টার্গেট করে বিভিন্ন কৌশলে বাসায় ডেকে নিতেন। তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতিও দেখাতেন। এভাবে ব্ল্যাকমেল করে হাইপ্রোফাইল অনেকের থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করেছে তারা।
রিমান্ডে নিতে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশ বলেছে, সমীর সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করে উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলতেন। পরে সুকৌশলে অর্থ আদায় করতেন। সেভাবে তিনি সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসাকেও ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেন। তারা সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছে ৫০ লাখ ডলার দাবি করেছিলেন।
সূত্র বলছে, সৌদি আরবের সদ্য বিদায়ি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের পরিচয় হয়েছিল আট মাস আগে। সেই পরিচয়েই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্য। মেঘনার পরিবারের দাবি, পরিচয়ের মাত্র চার মাস পর গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তাদের মধ্যে গোপনে বাগদান সম্পন্ন হয়। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি তারা।
মেঘনার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তারা তিন দশক আগে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসেন। মেঘনা ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালে তিনি ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। মডেলিং ছাড়াও উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করছেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। সূত্র: যুগান্তর