দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গত শুক্রবার থেকে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। এই সংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ পক্ষে আবার কেউ বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তিতর্কে মেতে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, শহরের আনাচে-কানাচে ও গ্রাম-গঞ্জে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানেও আলোচনা হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ‘ভিসানীতি’ নিয়ে। তবে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর টকশো আরো রসদ জুগিয়ে দিচ্ছে এই ইস্যুতে। বলা যায় ‘ভিসানীতির আলোচনায় চাঙ্গা এখন রাজনীতির মাঠ। তবে নিউইয়র্কে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভিসানীতি নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। প্রয়োজনে তিনি পাল্টা ভিসীনীতি প্রয়োগের হুঁশিয়ারিও দেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরু করায় যে যেভাবে পারছেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। অভিজ্ঞ মহলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভিসানীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে অবিরত।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ভিসানীতির ফলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, তারা নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে সহিংসতা চালালে ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। তারা দাবি করছেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসানীতির বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই। সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা। তবে বিএনপি নেতারা মনে করেন, ভিসানীতির কারণে ক্ষমতায় থাকা দলটি চাপে পড়বে। কেননা আওয়ামী লীগের নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের অংশ অনেকেই এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বেন। তবে কূটনীতিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি নির্বিশেষে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি কোনো সুখবর নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাট বাণিজ্য সম্পর্ক, বিনিয়োগ এবং রেমিট্যান্স ঘিরে সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য এই দেশটি থেকে এমন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়। অভ্যন্তরীণ সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসন করা গেলে এমন নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যেত বলেও মনে করছেন তারা। তারা এও বলছেন, বাইডেন প্রশাসনের একটা প্রবণতা হলো, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অধিক জোর দেওয়া। এতে তারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয়ে সহায়তা করা তাদের সেই নীতিরই অংশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার এবং মানবাধিকারের কথা বলে আসছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়েও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়েছে। তবে এবারের ভিসানীতি বাইডেন প্রশাসনের মস্তিষ্কপ্রসূত নতুন ধরনের ধারণা। এটার মাধ্যমে তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জোর দিচ্ছে। ফলে অস্ত্র বিক্রির ইস্যুকে এক করে দেখা যায় না। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের করণীয় হলো, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ইতিবাচক অগ্রসর হওয়া। বাইডেন প্রশাসনের ভিসানীতির লক্ষ্য হলো, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করলে তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এক্ষেত্রে, বিএনপিসহ বিরোধী দল যে আন্দোলন করছে সেই আন্দোলনে সফল না হলে ভোট প্রতিহত করতে সহিংসতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের নেতারাও ভিসা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, “ভিসানীতির প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে, তারা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে। এখন সেটা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই অ্যাকশনে অবশ্যই অস্বস্তিতে আছে। যদিও বিএনপি কিছুটা উল্লসিত কিন্তু বাস্তবে কারও জন্য উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই।”
একই কথা জানিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ উদ দৌলা। তিনি বলছেন, “বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি। র্যাবের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিয়েছে। এখন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য এসব হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত হবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করা। ইচ্ছা থাকলে উপায় হবে। সদিচ্ছা জরুরি।”
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই ভিসানীতি দেওয়ার কারণে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ঠিক হবে এই চিন্তা করাটাই ভুল। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে ঘাটতি আছে সেটি দেশের জনগণকেই ঠিক করতে হবে।”
স্ববিরোধী আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের ওপর ইতোমধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে আওয়ামী লীগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সেটি আবারও ফুটে উঠেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা স্ববিরোধী কথা বার্তায় মেতে উঠেছেন। কেউ এটিকে ষড়যন্ত্র বলছেন, আবার কেউ বলছেন এটি নিয়ে তারা চিন্তিত নন। আসলে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা কি সেটি অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর। সর্বশেষ দুই সেলফিতেই রাজনীতির ফয়সালা হয়ে গেছে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগ ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না। ভিসানীতি-নিষেধাজ্ঞা হলে ক্ষতিটা তাদেরই যারা নির্বাচনে বাধা ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। ভিসানীতি বাস্তবায়নের বাস্তবতাটা কী সেটা দেখার বিষয়।”
তবে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেছেন, “ভিসানীতির ফলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়ছে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী। কারণ এই ভিসানীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচনকে যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের উপরে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা।”
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, “আমরা আমেরিকা যাব না। তাতে এই বাংলাদেশে নির্বাচন উন্নয়ন কোনো কিছুই বাধাগ্রস্থ হবে না। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে যখনই নির্বাচন এসেছে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আমাদের পক্ষে ছিল না। এখনও পক্ষে নাই।”
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, “ভিসানীতি ভোগাস। সব ফাঁকা আওয়াজ, মাঠ অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা। লবিস্টের ফিস হালাল করার পাঁয়তারা।”
সরকারকে দোষারোপ করছে বিএনপি
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন। অনেকটা উচ্ছ্বাসের সুরে বিএনপির নেতারা সরকারকে দোষারোপ করেছেন। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করার ঘটনাকে বাংলাদেশের জন্য ‘অপমানজনক ও লজ্জাজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, “সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।”
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ এসেছে। এটি আমাদের দেশের জন্য প্রাপ্য নয়।”
একই সুরে কথা বলেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। তিনি বলেন, “আমাদের দেশের ৫২ বছর বয়স হয়েছে। এই ৫২ বছর বয়সে আমাদের অর্জন আমেরিকার স্যাংশন ও ভিসানীতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় থাকা অবস্থায় শুক্রবার ভিসানীতির কার্যক্রম চালু করেছে। কেন করেছে? কারণ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নাই। ভোটের অধিকার নাই। মানবাধিকার নাই। আর এই কারণে আমেরিকা আগে স্যাংশন দিয়েছিল, এখন ভিসানীতি কার্যক্রম শুরু করেছে। শোনা যাচ্ছে, সরকারি দলের দায়িত্বশীল অনেক নেতা, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এবং সচিব পর্যায়ের অনেকেই এই ভিসানীতির আওতায় পড়েছে। কেন বাংলাদেশের ওপর ভিসানীতি আসবে? এটা কোনো আনন্দের সংবাদ না।”