মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) বিকেল গড়িয়েছে। ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা অতিক্রম করার চেষ্টা করছে চারটার গণ্ডি। তখনো কাজ কমেনি মধুবাগ এলাকার পাগলা মিস্ত্রির রিকশার গ্যারেজে। একপর্যায়ে গ্যারেজে ঢুকলেন বেঁটে মতো এক ব্যক্তি। মাথা ভর্তি ছোট চুল আর গাল ভর্তি চাপ দাড়ি। শরীরে মোড়ানো হলুদ-কালো চেক টি শার্ট ও কালো লুঙ্গি।
গ্যারেজে এসে সিগারেট ধরিয়ে নতুন একটি রিকশা টেনে এনে বসলেন রঙের কৌটা আর তুলি নিয়ে। সিগারেট টানতে টানতেই শেষ করলেন রং নির্বাচন আর মিশ্রণের কাজ। এরপর শুরু করলেন রিকশা চিত্রের কাজ।
এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ বাবু। তিনি পরিবার নিয়ে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় থাকেন। রিকশার সঙ্গে তার পরিচয় প্রায় ২০ বছর ধরে। তুলির আঁচড় আর রঙের ছোঁয়ায় নিপুণ হাতে রিকশাকে রাঙিয়ে তোলাই তার একমাত্র কাজ। অর্থাৎ তিনি একজন রিকশার চিত্রশিল্পী।
সম্প্রতিক ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ইউনেসকো ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে একজন চিত্রশিল্পী হিসাবে বাবুর মুখে হাসি ফুটলেও, মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেছে সেই হাসি।
কাজের স্বীকৃতি বিশ্ব দিলেও, ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়ার আক্ষেপ নিয়ে বাবু বলতে থাকেন, “একটা সময় ছিল। মাসে ২ থেকে ৩ টা গ্যারেজে ৩০ থেকে ৩৫ টা রিকশায় রঙের কাজ হতো। এখন আর আগের মতো কাজ নেই। এখন সারা মাসে ২০/২৫ রিকশায় রঙের কাজ পাই। যে কাজে আয় বেশি সেই কাজেই মানুষ ঝোঁকে বেশি। আমার ভালো লাগা আর আয়ের উদ্দেশ্যে এই পেশায় এসেছিলাম। কিন্তু এখন সেই আয় করতে পারি না। কোনো মতো সংসার চলে। আমাদের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে ভেবে অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু আয় কমে যাওয়ায় দিন এখন ভালো যায় না।”
দেশের অন্যতম ব্যস্ত নগরী ঢাকার সঙ্গে রিকশার পরিচয়ের সময়টা প্রায় আশি বছরেরও বেশি। সময় গড়িয়েছে অনেক। চিত্রশিল্পীরাও বাহনটিকে রাঙিয়েছেন আপন-আপন ভাবনায়। যার প্রতিচ্ছবি আজও দেখা যায়, এই শহরের পিচ ঢালা পথে-পথে।
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, পালকির বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবন হয় তিন চাকার যান রিকশার। তবে কে আবিষ্কার করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উদ্ভাবক মার্কিন মিশনারি জোনাথন স্কোবি। তিনি ১৮৬৯ সালে রিকশা উদ্ভাবন করেন।
জানা যায়, ১৯৩৮ সালে প্রথম ঢাকায় আসে সাইকেল-রিকশা। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এই বাহন। বাহনটিকে নান্দনিক ও আরও আকর্ষণীয় করতে এর পেছনের অংশে জুড়ে দেওয়া হয় শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম। পর্যায়ক্রমে এই শিল্প ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এই কাজের পেশাজীবী এক শ্রেণি। অর্থাৎ যারা এর চিত্রশিল্পী। যার উদাহরণ মোহম্মদ বাবু।
বাবু ভাগ্য পরিবর্তনের আক্ষেপ প্রকাশ করলেও বিপরীত কথা শোনা গেল রিকশাচালক সুরুজ মিয়ার মুখে। তার দাবি, ব্যস্ত এই নগরীতে বর্ণিল রিকশার চাহিদা একটু বেশি। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক আর সহজ প্রযুক্তির কারণে এখন হারিয়ে যাচ্ছে এসব চিত্রশিল্পী।
রিকশা চালক সুরুজ বলেন, “নতুন-পুরাতন রিকশার জমা একই। রঙিন গাড়িতে মানুষ বেশি উঠে। তাই নতুন গাড়ি চালাই সব-সময়।”
ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নেসার হোসেন বলেন, “এই অঞ্চলে রিকশা চিত্রের প্রচলন চল্লিশের দশকের শেষ দিকে শুরু হয় এবং পঞ্চাশের দশকের দিকে বাড়তে শুরু করে। আগে যে পরিমানে এই চিত্রের শিল্পীরা ছিলেন। বর্তমানে তার সংখ্যা কম। আগে সব রিকশার পেছনে আঁকতে হতো। এখন ডিজিটাল প্রিন্ট এসে ছবি কপি করে ফেলেছে। ফলে বিষয়টি এখন সস্তা হয়ে গেছে। এমনটা হবেই। এখন রাষ্ট্রীয় কিছু পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।”