পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, জনমনে শঙ্কা ও টানটান উত্তেজনা নিয়ে শনিবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীতে শুরু হয় তিনটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি। দুর্ঘটনা বা সংঘর্ষ এড়াতে কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। শেষতক প্রাণ হারিয়েছেন পারভেজ নামের এক পুলিশ সদস্য। আহত হয়েছেন আরও ৪১ পুলিশ ও ১৯ সাংবাদিক। আহত সাংবাদিকদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। পোড়ানো হয়েছে তিনটি বাস, ২টি মাইক্রোবাস ও ১৬টি মোটরসাইকেল। বাদ যায়নি হাসপাতালও। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে আগুন দিয়ে চিকিৎসারত রোগীদের মাঝে তৈরি করা হয়েছে ভয়াবহ পরিস্থিতি।
২৮ অক্টোবর ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনার অনেক কিছুই শনিবার বাস্তব হতে দেখেছে রাজধানীবাসী। দিনভর চরম ভোগান্তিতে ছিল ঘর থেকে বের হওয়া মানুষ। সড়কে যানবাহন সংকটে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে নগরবাসীকে। আবার অলি-গলির অনেক সড়কে তিন-চারগুন ভাড়া দিয়ে বাসায় ফিরতে হয়েছে অনেককে। এমন দুর্ভোগ আর অপ্রত্যাশিত ঘটনার মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি।
শনিবার আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত নেতাদের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। এ সময় পুলিশ, জামায়াত, বিএনপি ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে এক পুলিশ সদস্য নিহত ও প্রায় ৪১ জন আহত হন।
সমাবেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন ১৯ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। এছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ পথচারিও সংঘর্ষে আহত হয়েছেন।
এদিকে দুপুরের দিকে প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও হামলা চালানো হয়েছে। রাজধানীর কাকরাইল মোড়, মালিবাগ ফ্লাইওভার ও কমলাপুরে তিনটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় সেখানে থাকা অ্যাম্বুলেন্সসহ ১৯টি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের দাবি, বিএনপির নেতাকর্মীরা হাসপাতালে ঢুকে এই আগুন লাগিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাকরাইলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপর মতিঝিলের আরামবাগে জামায়াতের কর্মীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে সেখানেও সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে জামায়াত কর্মীরা ব্যারিকেড ভেঙে শাপলা চত্বরে গিয়ে জমায়েত হয়। এভাবে বাড়তে থাকে উত্তেজনা।
আবার বিজয় নগরে বিএনপি কর্মীরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে এবং কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, পরে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, “বিএনপি যেসব শর্তে অনুমতি নিয়েছিল, তারা তা ভঙ্গ করেছে। কোনো উসকানি ছাড়াই তারা পুলিশের ওপর হামলা করে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও ভাঙচুর চালিয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের গেট ভেঙে তারা ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।” হামলাকারীদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
এভাবে দিনভর সংঘর্ষের পর আবার তিন দলই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। পল্টনে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ায় সমাবেশ পণ্ড হওয়ার আগমুহূর্তে রোববার (২৮ অক্টোবর) সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির এই কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছে সরকারবিরোধী জোট গণতন্ত্র মঞ্চ।
শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক গণসমাবেশে এ ঘোষণা দেন মঞ্চের শরিক ভাসানী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু। তিনি বলেন, “আইয়ুব-মোনায়েমকেও হার মানিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। আমাদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরই প্রতিবাদে রোববার দিনব্যাপী সারা দেশে হরতাল পালন করা হবে। সবাই হরতাল পালন করুন।”
একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াত ইসলামীও। শনিবার সন্ধ্যায় দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাছুম এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “শাপলা চত্বরে জামায়াত ঘোষিত শনিবারের মহাসমাবেশ বানচাল করার হীন উদ্দেশ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছে। সভা ও মিছিল করা যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীদের বাস, লঞ্চ ও ট্রেন থেকে নামিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা এই অন্যায় গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
এদিকে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ থেকে আগামী নির্বাচনে ফাইনাল খেলার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শনিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে তিনি এ ঘোষণা দেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির নৈরাজ্যের হরতাল কেউ মানবে না। এই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেছে। এই ভোঁতা অস্ত্রে কাজ হবে না। আমরা আগামীকাল সারা দেশে শান্তি সমাবেশ করব।”
তিনি আরও বলেন, “খেলা হবে। মির্জা ফখরুল কোথায়? বিএনপি কোথায়? বিএনপির মহাযাত্রা এখন মহা মরণযাত্রা। সেমি ফাইনাল সামনে। তারপরে ফাইনাল। নির্বাচন ফাইনাল খেলা। খেলা হবে।”