ঈদ উৎসব ঘিরে রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও হেলপারের মতবিরোধের চিরচেনা চিত্র আবার দেখা গেছে। চার্ট ও ওয়েবিলের নামে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তোয়াক্কা না করে বাড়তি আদায় করার অভিযোগ যাত্রীদের। তবে ঈদের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে ভাড়ায় বাড়তি হিসেবে যুক্ত হয় বকশিস, যা নিয়ে হরহামেশাই যাত্রীদের সঙ্গে হেলপারের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে দেখা যায়। শুক্রবার (১৪ জুন) রাজধানীর একাধিক সড়কের গণপরিবহনে ঘুরে এসব চিত্র দেখা যায়।
বিভিন্ন সড়কে চলমান বাসে যাত্রীর গন্তব্য বিবেচনায় ৫ থেকে ১০ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। বেশিরভাগ সময় এর কোনো কারণও ব্যাখ্যা করছেন না হেলপাররা। যাত্রীরা জানতে চাইলে ঈদ বোনাস বা বকশিস হিসেবে বেশি রাখার কথা বলছেন তারা।
গুলিস্তান থেকে মগবাজার-মহাখালী হয়ে টঙ্গি-গাজীপুর চৌরাস্তা যায় গাজীপুর পরিবহন। মগবাজার থেকে মহাখালী পর্যন্ত এই পথের স্বাভাবিক ভাড়া ১০ টাকা। তবে যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ৫ টাকা নিয়ে ১৫ টাকা ভাড়া রাখছে বাসগুলো। আর এর থেকে দূরের যাত্রীদের থেকে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ১০ টাকা।
এ অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা বলছেন, এসব পথে দিনে একাধিকবার তাদের যাতায়াত করতে হয়। প্রতিবার এভাবে বকশিস দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। আর ঈদের এখনও তিনদিন বাকি। এখন থেকেই যদি এটা শুরু হয় তাহলে ৫-৬ দিনে যাত্রীদের থেকে তারা কতা টাকা অতিরিক্ত আদায় করবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গণপরিবহনে চলাচল করা সব যাত্রীর আর্থিক অবস্থা এক নয়। তাদের কেউ কেউ নিজেরাই শ্রমজীবী। তাদের থেকে বাধ্যতামূলক বকশিস আদায় কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
মৌচাক থেকে এয়ারপোর্টগামী যাত্রী আবিদ আহমেদ ভাড়া বেশি রাখার অভিযোগ করে বলেন, “এই পথের স্বাভাবিক ভাড়া ৪০ টাকা। আমার থেকে ৫০ টাকা ভাড়া রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে বলছে ঈদের বকশিস। এটা তারা চাইতে পারে কিন্তু নিজে থেকে কীভাবে রেখে দেয়। তারা অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে যাত্রীদের থেকে এই টাকা আদায় করছে। আমি প্রতিদিন ব্যবসায়িক কাজে দুইবার এই পথে আসা যাওয়া করি। ঈদের আগেরদিন পর্যন্ত এই চলাচল অব্যাহত থাকবে। প্রতিদিন এভাবে বকশিস দেওয়া তো সম্ভব না।”
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে মগবাজার ফেরার পথেও একই চিত্র দেখা গেছে। এতে বিশ টাকার পরিবর্তে ভাড়া বাবদ খরচ হচ্ছে ৩০ টাকা। একই অবস্থা যাত্রাবাড়ী থেকে কুড়িল বিশ্বরোড সড়কে। মুগদা থেকে রামপুরা পর্যন্ত বাস ভাড়া ১৫ টাকা হলেও যাত্রীদের থেকে রাখা হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এ নিয়ে গ্রেট তুরাগ পরিবহনে এক যাত্রীর সঙ্গে চালক ও হেলপারের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতেও দেখা যায়।
তবে এটাকে বাধ্যতামূলক না বলে ঈদের উপহার দাবি করছেন হেলপাররা। গ্রেট তুরাগ বাসের হেলপার রমিজ মিয়া বলেন, সবাই ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। আর আমরা মানুষের সুবিধার্থে গাড়ি চালাচ্ছি। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের থেকে নামেমাত্র কিছু টাকা বেশি রাখছি। সেটাও যাত্রীর ইচ্ছেমতো। আমরা কাউকে জোর করছি না। অন্য সময় তো আর বেশি চাই না। এটা ঈদের দুই-তিনদিনের একটা ব্যাপার।
এদিকে, বকশিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কে অন্যায্য ও যাত্রীদের ওপর নিপীড়ন বলছেন যাত্রীদের অধিকার সংশ্লিষ্টরা। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহন নিয়ে আমাদের দেশে একটা নৈরাজ্য চলছে। এখানে নিয়মনীতি যাদের কার্যকর করার কথা তারাই উল্টো অনিয়মের সুবিধাভোগী। ফলে সাধারণ যাত্রীরা অবহেলিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। ঈদকেন্দ্রিক বকশিস তার মধ্যে একটি।
পরিবহন চালক- হেলপারদের বোনাস ভাড়ায় যুক্ত জানিয়ে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “আমরা যে ভাড়া প্রদান করি তার মধ্যে চালক- হেলপারের বেতন ও দুই ঈদের বোনাসও অন্তর্ভুক্ত। এটা মালিক পক্ষ তাদের বুঝিয়ে দেওয়া কথা। কিন্তু তা না করে মালিকপক্ষ তাদের থেকে ঈদের মতো উৎসবে বোনাস আদায় করছে। অথচ বিষয়টা উল্টো হওয়ার কথা। পথে পথে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সেখানেও বোনাস আদায় করা হচ্ছে। আর এগুলো যাদের দেখার কথা সেই কর্তৃপক্ষও পরিবহনগুলো থেকে ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। ফলে এসব অনৈতিক অর্থ প্রদানের চাপ এসে পরছে যাত্রীদের ওপর।”
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, “রাজধানীর অভ্যন্তরে গণপরিবহনগুলোতে ৫, ১০, ২০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। আর আন্তঃজেলা বাসগুলোতে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ১৩০ টাকার ভাড়া ৩০০ টাকা রাখা হচ্ছে। আড়াইশ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা রাখা হচ্ছে। এটা কখনও মেনে নেওয়া যায় না। কর্তৃপক্ষের উচিৎ নামমাত্র নজরদারি না করে মানুষের ভোগান্তি কমাতে এগিয়ে আসা।”