পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপপুরের এই প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা। পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রথম অবস্থায় এটি করাচিতে চলে গেলেও পরবর্তীতে তিনি রাশিয়াসহ বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দেশেই এইটি করার স্বপ্ন দেখেন। এজন্য প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পিতার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পেরে আমি গর্বিত ও আনন্দিত।”
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটি দেশের পরমাণু শক্তি স্থাপন, উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে সকল শর্ত ও নিয়মকানুন মানা দরকার সেগুলো অনুসরণ ও পালন করা হয়েছে। সব ধরনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাপনা।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের পারমাণবিক শক্তি শান্তির লক্ষ্যে ব্যবহার করা হবে মর্মেই আমরা চুক্তি সম্পাদন করেছি রাশিয়ার সঙ্গে। তারা নিজ দায়িত্বে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরবর্তী সকল বর্জ্য নিয়মতান্ত্রিক ফর্মুলায় তাদের দেশে নিয়ে যাবে। সব ধরনের ঝুঁকি মুক্তভাবে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনর কেন্দ্র পরিচালিত হবে।”
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা ভিশন নিয়ে কাজ করছি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার একটি ধাপ। বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করবে।”
অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমিন পুতিন বলেন, “বাংলাদেশ রাশিয়ার পরীক্ষিত বন্ধু। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দু-দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশের পরমাণু সেক্টরের সফলতার জন্য সব ধরনের সহায়তার প্রদানে রাশিয়া সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। আমরা সফলভাবে প্রথম স্তরের জ্বালানি হস্তান্তর সম্পন্ন করলাম। দ্বিতীয় পর্যারের জ্বালানিও ওই দেশে পৌঁছে গেছে।”
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, “বন্ধুপ্রতীম দেশ বাংলাদেশের জন্য রাশিয়ার দরজা খোলা থাকবে। রাশিয়া বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ভিত্তি হলো সমতা আর সম্মান।”
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে ভবিষ্যতে থাকার কথা জানিয়ে ভ্লাদিমিন পুতিন বলেন, “২০২৪ সালে প্রথম ইউনিট ও ২০২৬ সালে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু হবে।”
পারমাণবিক জ্বালানি ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়ামের মালিক হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল বাংলাদেশ। ঐতিহাসিকভাবে ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তির যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। বিশ্বের ৩৩তম ইউরেনিয়ামের দেশ এখন বাংলাদেশ।
এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা ৫২ মিনিটে ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনলাইনের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সবুর আলী, মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ ও প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবরসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দেশিবিদেশিরা।
হস্তান্তর উপলক্ষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আয়োজন করা হয় গ্রাজুয়েশন সেরিমনি। দুই দেশের সরকার প্রধানের অনুমতিতে সেখান পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। এটি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলো বাংলাদেশ।
এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানযোগে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জ্বালানির প্রথম চালান। পরের দিন ২৯ সেপ্টেম্বর বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সড়ক পথে জ্বালানি নেওয়া হয় প্রকল্প এলাকায়। দ্বিতীয় চালান ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছে গেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বৃহৎ প্রকল্প। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারের ব্যয় ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আর ২০২৫ সালের মাঝামাঝি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট চালু হতে পারে। দুটি ইউনিট চালু হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ইউনিটের ভৌত এবং অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়ে গেছে ৯০ শতাংশের বেশি। আর দ্বিতীয় ইউনিটের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ।