টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ফের ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ রাজনৈতিক দলটি দেশের ইতিহাসে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলেও অর্থনীতির তেমন কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি, বরং শক্তিশালী ‘সিন্ডিকেট’ সৃষ্টি হয়েছে তাদের মেয়াদে। চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে এই সিন্ডিকেট নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন এ সরকার গঠনের পর অনেক চেষ্টা করেও এই ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এতে বছরজুড়েই দ্রব্যমূল্যের বাজারে ছিল অস্থিরতা। যা এখনো চলমান আছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর ব্যর্থতা
চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু। দায়িত্ব গ্রহণের পর বাজার নিয়ন্ত্রণে ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন টিটু। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। বরং, দ্রব্যমূল্যের বাজারে আরও অস্থিরতা দেখা দেয়।
গত ১৫ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আহসানুল ইসলাম টিটুকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির অতীতে দেখা যায়নি, আপনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন কিনা”, জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের এখতিয়ারে যা আছে তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পণ্য সরবরাহে যারা প্রতিবন্ধকতা, কারসাজি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অস্বচ্ছতা শনাক্ত করার যথেষ্ট সিস্টেম বা টুলস আছে। ভয় দেখানোর জন্য বলছি না। ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করব, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে ব্যবসা হলে সহযোগিতা পাবেন। কিন্তু কোনো কারসাজির মাধ্যমে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চাইলে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এরপর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ব্যবসায়ী হয়ে মন্ত্রী হওয়ার পর ব্যবসায়ীদের পক্ষে চলে যায়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? জবাবে টিটু বলেন, “আমি ব্যবসায়ী এজন্য কোনো সমস্যা নেই। আমি সহায়তা করব, কিন্তু আমি ব্যবসা করব না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমার কোনো যোগসাজশ হওয়ার সুযোগ নেই। কোনো ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থ রক্ষা করতে আমি এ সিটে বসিনি।”
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর এমন প্রতিশ্রুতিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পরও বাজারের অস্থিরতা কমেনি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতি সাবেক সরকার ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেককে। এরপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন টিটু।
‘সিন্ডিকেট’ ইস্যুতে আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, “আমাদের ওপর আস্থা রাখেন। আমাদের অবস্থান থেকে প্রচেষ্টা কম থাকবে না। ভায়োলেট হলে জবাব দেব। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এখন থেকে যা হবে আমাদের এখান থেকে প্রচেষ্টা কম থাকবে না। কেউ পণ্য সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে জরুরি আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এভাবে চলে কিছুদিন। এসময় বাজারে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরও সক্রিয়ই থেকে যায় অদৃশ্য ‘সিন্ডিকেট’। অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েই যায়।
‘জুলাই-আন্দোলন’ শুরুর আগে গত ৭ জুন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন আহসানুল ইসলাম টিটু। সেখানেও তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতিকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
টিটু বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমাতে আমরা ভর্তুকির পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যেও পণ্য বেচব। নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি আমরা। আমরা ট্রাক সেলের পাশাপাশি স্থায়ী দোকানের ব্যবস্থা করছি। এই ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে টিসিবির ভর্তুকি মূল্যের পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যেও পণ্য বিক্রি করা হবে। এতে করে ভোক্তারা উপকৃত হবেন।”
‘সিন্ডিকেট’ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারের চেষ্টা ও ব্যর্থতা
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের পুরো অর্থনীতির চাপ এসে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। যদিও দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। অর্থনীতি সচল রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেই ‘সিন্ডিকেটের’ কাছে তারাও ‘ব্যর্থ’ হন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার পরও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজার অস্থিরই থাকে।
সরেজমিনে দ্রব্যমূল্যের দাম দেখতে মধ্যে গত ১৫ অক্টোবর বাজার পরিদর্শনে যান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিত্যপণ্যের দরদাম ও সরবরাহ পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “বাজারে ডিমসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে এটা ঠিক। এ ক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেটের’ কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। তবে বাজারে পণ্যের সরবরাহ যাতে বাড়ে ও দাম কমে আসে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।”
এ সময় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা স্বীকার করছি যে পণ্যর দাম বেড়েছে। তবে দাম বাড়ার কারণও আছে। চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ কম। বাজারে বর্তমানে সবজিপণ্যের সরবরাহে বেশ সংকট রয়েছে। কারণ, সবজির উৎপাদন কমেছে। গত কয়েকটি বন্যা ও টানা বৃষ্টিতে অনেক সবজি নষ্ট হয়েছে। এখন উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকলে যতই বাজার তদারকি করা হোক, দাম খুব কমিয়ে আনা যাবে না।”
‘সিন্ডিকেট’ করে পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে, এ বিষয়ে সরকার কী করছে তা জানতে চান এক সাংবাদিক। এর জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সিন্ডিকেটের কথা বলে তো পার পাব না। তবে সিন্ডিকেট যেন না হয় সেই চেষ্টা করা হবে। যারা ব্যবসা করেন, তারা লোকসান করুক, সেটা চাই না। তবে অতি মুনাফা করবেন তা–ও ঠিক না। ব্যবসায়ীদের অনেকে অত্যধিক মুনাফা করেন। তবে অতি মুনাফাকারী পাইকার বা খুচরা বিক্রেতা যে-ই হোক, সেটি দেখা হবে।”
অর্থ উপদেষ্টার উদ্দেশে এক সাংবাদিক বলেন, ‘অনেকে বলছেন সরকারের ব্যর্থতার কারণে গত দুই মাসে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে।’ এর জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আপনারা মাত্র ২ মাসে একটা সরকারকে ব্যর্থ বলেন। অথচ গত ১৫ বছরে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বললেন না। এটা যৌক্তিক না। খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন বিষয়। এটা কারখানায় তৈরি ও বিতরণের জিনিস না।”
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, “এমনভাবে তথ্য ছড়ানো হচ্ছে যে বাংলাদেশ যেন আফ্রিকার কোনো দেশের মতো হয়ে গেছে। অনেকে বলার চেষ্টা করছে যে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, সব জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব বার্তা স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে ভীতি সৃষ্টি করে।”
গত ২০ নভেম্বর সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) উদ্যোগে আলুসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ে কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। তিনি বলেন, “বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশকে উদার ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় বাজারে যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়, এখন দেশের ক্ষেত্রে (পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে) সিন্ডিকেট হলেও সমস্যা।”
মূল্যস্ফীতি কমাতে কিছু তাৎক্ষণিক ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “দাম বেড়ে যাওয়ার পরে আমরা টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে আলু বিক্রি শুরু করেছি। পাশাপাশি আলু আমদানির অনুমোদনও দেওয়া আছে। এসব তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ।”
শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, “জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়ে সরকার অবগত। দাম কমানোর ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ চেষ্টা জারি আছে। এখন পর্যন্ত নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ইতোমধ্যে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি আসতে শুরু করেছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও পরিমাণ আরও বাড়ানো গেলে দ্রুত দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আসবে বলে আশা করছি।”
বাজারে সিন্ডিকেটকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যুক্ত থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে উত্তর একটাই, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা দূর করে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে এই (নিত্যপণ্য) ব্যবসায় যুক্ত করা। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তার বক্তব্য, আপনারা আরও বেশি সংখ্যায় এসব ব্যবসায় যুক্ত হন এবং আরও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করুন।”
সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ে কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কি অনেক বেশি শক্তিশালী? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “সিন্ডিকেট না বলে বলুন ব্যবসায়ী যারা আছে তারা খুব শক্তিশালী। ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুব বড় ব্যবসায়ী, মাঝারি, আমদানিকারক, সরবরাহকারী, এজেন্ট আছে, এটা একটা কমপ্লেক্স। যেটা ভাঙা সহজ না।”
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “সবাইকে যদি আমরা একসঙ্গে ধরি, তাহলে দেখবেন বাজারে এর থেকে আরও বেশি প্রভাব পড়বে। আমরা চাই সবাই ব্যবসা করুক। তবে অতিরিক্ত লাভ করুক, তা চাই না। আমরা চাচ্ছি আমাদের দিক থেকে সরবরাহটা থাকুক। যাতে ব্যবসায়ীদের কাছে একটা ম্যাসেজ যায়।”
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “আমরা পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাই। আজকে সার, সয়াবিন তেল, চাল, মসুর ডাল ক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছি। এতে সয়াবিনের দাম সহনীয় হতে পারে। রমজান পর্যন্ত যত ধরনের নিত্যপণ্য আছে—চাল, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি এগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করে চেষ্টা করছি, বাজারটা যাতে আরেকটু সহনীয় থাকে। তবে একটু সময় লাগবে। কারণ এগুলো দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। লোড আনলোডে সময় লাগে।”
ভোক্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে বাজারে মনিটরিং হচ্ছে না, সে জন্য দাম বাড়ছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “বাজার মনিটরিং হচ্ছে না, বিষয়টা কিন্তু তা না। অন্যান্য দেশে কিন্তু এরকম হয় না। বাজারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কয়টা জায়গায় যেতে পারে। কিছু দিন আগে আমি পাবনা গেলাম সেখানেও একই অবস্থা। ডিসিদের কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তারা বাজারে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ঠিক থাকে। চলে এলে যেই সেই অবস্থা। এ জন্য ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে।”