রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থী অনেকটা আতঙ্ক নিয়েই বললেন, “বড় ভূমিকম্প হলে বেশিরভাগ ভবনই ধসে পড়বে। কারণ বেশিরভাগ ভবন বা স্থাপনা কাঠামোগত ও নকশার মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।” বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত মাঠ পর্যায়ের জরিপের ফলাফল থেকে এমন মন্তব্য করেছেন ওই শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় জরিপ টিমের আরেক সদস্য ফয়সাল জুনায়েদ বলেন, “তিলোত্তমা ঢাকা শহরের বেশিরভাগ উঁচু ভবনে নাকশায় ত্রুটি আছে। তাছাড়া বিল্ডিং কোডও পুরোপুরি মানা হয়নি। প্রকৌশলীরা যেভাবে ভবন তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নকশা উপেক্ষা করা হয়েছে।”
জরিপ টিমের সদস্যরা জানান, কয়েক দশক আগের তৈরি ভবনগুলো আরও বিপজ্জনক। কতমাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে সে বিষয়টি কোনো বিবেচনাতেই নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, যত্রযত্র এমনকি পুকুর ডোবা ভরাট করেও তৈরি হয়েছে শত শত ভবন। যেসব ভবন কয়েক বছর ধরেই চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অথচ সেসব ভবনে দিব্বি মানুষ বসবাস করছেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বের মধ্যে ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যে ২০টি শহরের তালিকা করা হয়েছে তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। গত এক দশক ধরে বিশেষজ্ঞরা ভবন তৈরিতে ভূমিকম্পের মাত্রার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বললেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে।
শুধু যে রাজধানীতে এভাবে বিপজ্জনক ভবন তৈরি হয়েছে, তাই নয়, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও নিয়ম না মেনে শত শত ভবন তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জৈন্তাপুরেও ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প ঝুঁকির সতর্কতা মানা হয়নি। ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে থাকা সেসব এলাকায় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে রাজধানীতে অকল্পনীয় মাত্রার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালে করা এক জরিপে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের মতো এলাকার বেশিরভাগ স্থাপনা বা ভবন কাঠামোগত ও নকশার মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। পুরাতন ভবনগুলো এমনিতেই বিল্ডিং কোড মানার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। তবে নতুন ভবনগুলোও একইভাবে নকশা বা অবকাঠামোর বাধ্যবাধকতা না মেনেই তৈরি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ভবন ধসের ঘটনা ঘটে রাজধানীর অদূরে সাভারের রানা প্লাজায়। সেই ধসের ঘটনায় প্রাণ হারায় ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি লোক। মর্মান্তিক এই ঘটনার পেছনে রয়েছে ভবন নির্মাণে অবকাঠামোগত গাফিলতি। রানা প্লাজার ঘটনা দেশে দুর্বলভাবে নির্মিত ভবনগুলোর সৃষ্ট বিপদের ভয়াবহ একটি দৃষ্টান্ত।
নতুন বছরের শুরুতেই প্রথম সাত দিনে দেশে পরপর দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গত ৩ জানুয়ারির ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের হোমালিনে। যা ছিল মাঝারি মাত্রার। আর ৭ জানুয়ারি সকালে অনুভূত হওয়া তীব্র ধরনের ভূমিকম্পের উৎস ছিল ঢাকা থেকে ৬১৮ কিলোমিটার দূরে চীনের জিজাংয়ে। মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ১। যা শুধু চীন নয়, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে একযোগে অনুভূত হয়েছে।
দুটো ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বাইরে হলেও পরপর হওয়া ভূমিকম্প কিছুটা দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীরের ভাষ্য, “এত দূরে উৎপত্তি হওয়া দুটো ভূমিকম্পের তেমন কোনো প্রভাব আমাদের এখানে নেই।”
আন্তঃদেশীয় ঝুঁকি মূল্যায়ন
বাংলাদেশে আন্তঃদেশীয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন চালু করা হয়েছে সদ্য বিদায়ী বছরের মার্চে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যালয় ও গ্লোবাল ভূমিকম্প মডেল ফাউন্ডেশনের সহায়তায় কার্যকর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ঢাকায় চার দিনব্যাপী প্রচার অনুষ্ঠানে ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে ভূমিকম্পের ধরনের ওপর কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যা পরবর্তী প্রজন্মকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় প্রস্তুত করে। তবে সে সময়ে মূল্যায়নে কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
যেসব দুর্বলতা বিদ্যমান
ভঙ্গুর অবকাঠামো: হাসপাতাল, জরুরি প্রতিক্রিয়া কেন্দ্র এবং সরকাররি দপ্তরগুলো এমন কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। যা ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করার জন্য জরুরি পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন।
নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি: বিল্ডিং কোডের দুর্বল প্রয়োগ এবং দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
জনসচেতনতার ঘাটতি: জরুরি প্রটোকলগুলোর বিষয়ে কম বোঝার কারণে অনেক নাগরিক ভূমিকম্প পরিস্থিতির জন্য অপ্রস্তুত থাকেন।
যেসব কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে বিশেষজ্ঞরা একটি সমন্বিত, বহুমাত্রিক ক্ষেত্রভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। মূল সুপারিশগুলো হলো:
• শক্তিশালী বিল্ডিং কোড ও প্রয়োগ করা।
• ভূমিকম্প প্রস্তুতি সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো।
• গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্য সম্পদ বরাদ্দ করা।
• দক্ষতার সঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বেসামরিক-সামরিক সমন্বয় বৃদ্ধি করা।
আন্তঃদেশীয় মূল্যায়নের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার দুর্বলতাগুলোকে ভূমিকম্পের হুমকির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষায় রূপান্তর করতে পারে।