• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পি কে হালদারকে ‘বলির পাঠা’ বানিয়েছিল এস আলম


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৭:১২ পিএম
পি কে হালদারকে ‘বলির পাঠা’ বানিয়েছিল এস আলম
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম ও পি কে হালদার। ছবি: সংগৃহীত

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের সঙ্গে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের দারুণ মিল পেয়েছিলেন ব্যাংকাররা।

দেশে আর্থিক খাতের বড় বড় কেলেঙ্কারি আর বিদেশে বিপুল অর্থ ও সম্পদ পাচারসহ নানা কর্মকাণ্ডে দুইজনেই যেন দারুণ প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। তাদের দুর্নীতির মিল খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, তাদের দুইজনকেই আইন লঙ্ঘন করে অকাতরে সহযোগিতা দিয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পি কে হালদারের অদ্ভুত মিলের পেছনের রহস্য এবার বেরিয়ে এসেছে। দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার নেপথ্যে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের বিষয় উল্লেখ করে পি কে হালদারের পক্ষে চিঠি লেখা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। চলতি বছরের শুরুর দিকে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে চিঠিটি পাঠানো হয়।  

অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০২২ সালের ১৪ মে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পি কে হালদার ভারতেই কারাবন্দি আছেন। তার বিরুদ্ধে অন্তত দশ হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর অভিযোগ থাকলেও তিনি চিঠিতে তার আর্থিক কেলেঙ্কারির পেছনে এস আলম গ্রুপের কর্ণধারকে দায়ি করেছেন।

এ নিয়ে সম্প্রতি (২২ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক বাংলা। যেখানে উঠে এসেছে, এস আলম তার ‘কুকর্ম’ আড়াল করতেই পি কে হালদারকে ব্যবহার করেছেন। তাকে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলমের কর্ণধার নিজের কুকর্ম লুকাতে পিকে হালদারকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। এমনকি দেশে থাকাকালীন তাকে ডিজিএফআইয়ের টর্চার সেলে নেয়ার চেষ্টাও করা হয়। দেশ না ছাড়লে পি কে হালদারের জীবন নিয়েও সংশয় ছিল।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, পি কে হালদার যেন তার নিজ হাতে গড়ে তোলা কোম্পানিগুলোকে ধ্বংসের জন্য এস আলমের জোর-জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের কথা কাউকে বলতে না পারেন সেজন্য কৌশলে ভারতীয় ইডির (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট) মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে দেওয়া হয়।

পি কে হালদার দাবি করেছেন, এস আলমের কর্ণধার নিজের অপরাধ আড়াল করতে তাকে সবার সামনে অপরাধী বানিয়েছেন। আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি পরিষ্কার করেন পি কে হালদার। চিঠিতে দাবি করেন, ২০১৯ সালে দুদকের অনুসন্ধানের আগে-পরে কখনোই তিনি কানাডায় যাননি। বরং সেই বছরের ২২ অক্টোবর তিনি ভারতে যান। এর দুইদিন পরেই এস আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সিঙ্গাপুর যান। বেশ কিছুদিন মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে কাটানোর পর ভারতে ফিরে সেখানেই অবস্থান করেন।

চিঠিতে বলা হয়, ভারতে অবস্থানকালে পি কে হালদার নিজের গড়ে তোলা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালিয়ে নেয়ার জন্য তিনি দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। এ জন্য ২০২০ সালে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থও হন। আদালত প্রথমে তার পক্ষে আদেশ দিলে তিনি দেশে ফেরার লক্ষ্যে ভারত থেকে দুবাই চলে যান। সেখানে গিয়ে দেশে ফেরার টিকিটও কাটেন। তবে পরে জানতে পারেন আদালতের আদেশটি তার বিপক্ষে চলে গেছে। সেজন্য তিনি আর দেশে ফিরতে পারেনি।

চিঠিতে দাবি করা হয়, এস আলমের কৌশলের কারণেই পি কে হালদার দেশে ফিরতে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব কৌশল তিনি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেননি। পরে এস আলমের পরামর্শে ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন পি কে হালদার। আর ভারতে আসার পরেই এস আলম সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে গ্রেপ্তার করানো হয়। এমনকি গ্রেপ্তার হওয়ার পর হালদার যেন কোনো বিরূপ তথ্য প্রকাশ না করেন সেজন্য এস আলমের ছোট ভাই ভারতে গিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করে আসেন।

যেসব কারণে দ্বন্দ্ব
চিঠিতে বলা হয়, পি কে হালদার একজন মেধাবী ব্যক্তি। মেধার যোগ্যতা বলেই তিনি বেক্সিমকো গ্রুপ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি পেয়েছিলেন। মেধা আর যোগ্যতা দেখেই তাকে রিলায়েন্স ফিন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চাকরি দিয়েছিলেন সাইফুল আলম। ছয় বছর ধরে তিনি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি করা হয়। হালদার ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটিতে দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর পিকে হালদার নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। তবে একই বছরে সাইফুল আলম তাকে তাকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিতে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। সেই সঙ্গে হালদারের সব সম্পত্তি সাইফুলের নামে লিখে দেওয়ার জন্যও চাপ দিতে থাকেন।

দুদকে পাঠানো পি কে হালদারের চিঠিতে দাবি করা হয়, ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় প্রভাব খাটিয়ে দুদকের তালিকায় হালদারের নাম ঢুকিয়ে দেন সাইফুল আলম। অথচ ক্যাসিনো মামলায় বেশিরভাগ আসামি ছিলেন ছিল রাজনীতিবিদ। আর পি কে হালদার ছিলেন একজন ব্যাংকার।

পি কে হালদারের দাবি অনুযায়ী, সাইফুল আলমকে তখন সহায়তা করেছিলেন দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। পরে ইকবাল মাহমুদ ও সাইফুল আলমের ঘনিষ্ট এক ব্যক্তির পরামর্শে হালদার ভারতে চলে যান। কারণ তখন দেশ না ছাড়লে তার জীবননাশও হতে পারত বলে দাবি করা হয় চিঠিতে।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ে যা ঘটেছিল
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সম্মিলিত পোর্টফোলিও ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার হলেও প্রচার করা হয়েছে পুরো অর্থই পি কে হালদার নিয়ে গেছেন। যা ছিল ভিত্তিহীন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পিকে হালদার তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিলেও তার সিংহভাগ এস আলমের রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে দেওয়া হয়েছে। তবে রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক বিষয় এড়িয়ে গেছে।

চিঠিতে বলা হয়, পিকে হালদার তার যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে তখন ঋণ নেয়, সেগুলোর বেশিরভাগই লাভজনক ছিল এবং বাংলাদেশে দৃশ্যমান ব্যবসা পরিচালনায় ছিল। তারপরও প্রচার করা হয় সে সব কোম্পানির অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। মূলত ১৩টি কোম্পানি, পুঁজিবাজার ও জমিতে বিনিয়োগ করা তার অর্থের পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা বিদেশে নয়, দেশেই ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয়ের লক্ষ্য ছিল।

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) মোট পোর্টফোলিও ৮১৯ কোটি টাকা। প্রচার করা হয়, এখান থেকে দুই হাজার কোটি টাকা সরানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বিআইএফসির পোর্টফোলিওর পুরো অর্থই লুটপাট করে নেয় গুটিকয়েক সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান। বিআইএফসি থেকে তার কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো প্রকার ঋণ নেয়া হয়নি।

পিপলস লিজিং নিয়ে যা বলছেন হালদার
চিঠিতে বলা হয়, পিপলস লিজিং ২০১৫ সালের আগের পরিচালনা পর্ষদের হাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি ঠিক করার জন্য স্কিম পেশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তা আমলে না নিয়ে ২০১৫ সালের আগের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম হোসেনসহ পর্ষদের সদস্যদের দায়ী করা হয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্টে কোম্পানিটিকে অবসায়নের জন্য মামলা করে। পি কে হালদার এ কোম্পানি থেকে কোনো ঋণ নেননি। তারপরও প্রচার করা হয় তিনি ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক তার আর তার কোনো লোকের সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে কাউকেই মামলায় বিবাদী করেনি।

আনান কেমিক্যাল কি কাগুজে
চিঠিতে দাবি করা হয়, পি কে হালদারের আনান কেমিক্যালকে কাগুজে হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। অথচ ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত এর উৎপাদন সক্রিয় ছিল। তবে সেই বছরে দুদকের হস্তক্ষেপে কোম্পানিটি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। গত ৩ মে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বর্তমান চেয়াম্যান নজরুল ইসলাম খানের (সাবেক শিক্ষাসচিব) নেতৃত্বে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে কোম্পানির কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। পি কে হালদারকে প্রধান আসামি করে দায়ের করা মামলাটির সময় আনান কেমিক্যাল ঋণখেলাপি ছিল না, বরং এটি রেগুলার ঋণ ছিল। বিস্ময় প্রকাশ করে চিঠিতে বলা হয়, পি কে হালদারকে এ ঋণের জন্য প্রধান আসামি করা হলেও ঋণটি তার নামে অনুমোদন হয়নি।

এ বিষয়ে দুদক পরিচালক গুলশান আনোয়ার বলেছেন, যখন আনান কেমিক্যালের নামে মামলা হয় তখন এটি ছিল শুধু মাত্র জমি। যেহেতু একটি জমিকে ফ্যাক্টরি দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং হয়েছে তাই নিয়ম মেনে মামলা করা হয়েছে।

Link copied!