নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নতুন করে বাঁচার জন্য ঢাকায় আসেন ৮০ বছরের মনোয়ারা বেগম ও তার স্বামী। তাদের রয়েছে এক ছেলে। তিনি এখন রিকশাচালক। ছেলে আগে ভরনপোষণ দিলেও এখন আর দেয় না। ভিক্ষা করে স্বামীকে নিয়ে থাকেন এখানে।
সংবাদ প্রকাশকে মনোয়ারা বেগম বলেন, “দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে রাজধানীর মালিবাগ এলাকার মূল সড়কের পাশে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করি। ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে মশারি-কয়েল ছাড়াই দিন-রাত কাটে আমাদের। কিছুদিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আমার স্বামী অনেক অসুস্থ হয়। পরে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন। সরকার কোনো সহযোগিতা করে নাই।”
সরজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বস্তি ও সড়কের পাশের ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদের অধিকাংশদের ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা নেই। মশারি ব্যবহার ও থাকার ঘরের আশপাশে জমা পানি পরিষ্কার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের দাবি- সিটি কর্পোরেশনের লোকজন এখানে কখনো মশা নিধনের ওষুধ দিতে দেখা যায়নি।
এদিকে চলতি বছর ডেঙ্গুতে দেশে ৯২৮ জন মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার ৫৮১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৯ হাজার ৭১৬ জন।
মনোয়ারা বেগমের মতো এই বস্তিতে ৫২টি ঘরের কেউই মশারি ব্যবহার করেন না। কেউ মশারি বা সাহায্য-সহযোগিতা দেয় না জানিয়ে, ফাতেমা বেগম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “একবেলা খাবার না খেলে কেউ সহযোগিতা করে না। সেখানে মশার জন্য মশারি দিবে। পাঁচ বছর থাকি এই বস্তিতে। কেউ কোনোদিন এক পয়সার সহযোগিতা দিতেও আসে নাই।”
খিলগাঁও এলাকার রেললাইনের ঝুপড়ি ঘরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক নারী বিলকিস আক্তার। রাস্তায় রাতের বেলা পিঠা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দিনের বেলা মশা থাকে না। বৃষ্টি হলে আশেপাশে পানি জমে, মশা বেশি কামড়ায়। আমাদের পাশের ঘরে তিনজন থাকে তারা সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। তখন সবাই ভয় পেয়েছে।”
রেল লাইনের পাশের আরেক বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গুকে আর ভয় পাই না, মরলে অনেক আগে মরে যাইতাম, একবার জ্বর হয়ে ভালো হয়ে গেছি, এখন এমনিই সুস্থ আছি। এই এলাকাতে সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন দল কখনো আসেনি। অনেকের জ্বর হয়েছে আবার ভাল হয়ে গেছে।”
রিকশাচালক আব্দুল মালেক থাকেন খিলগাঁও এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজে। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গ্যারেজের ভিতর রাতে প্রচুর মশা কামড়ায়। এ নিয়ে মালিকেরও কোনো উদ্যোগ নেই। ডেঙ্গু মশা কামড়ালে জ্বর হবে। তখন আল্লাহ যা করবেন তাই হবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকা শহরে এখন দুই কোটি লোকের বসবাস। আর এর ৪০ ভাগ মানুষই বস্তিতে থাকেন অথবা ভাসমান। সেই হিসেবে তাদের সংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি। আরো ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন ঢাকা শহরে আসা-যাওয়া করেন। বস্তির মানুষ প্রান্তিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য কখনোই চিকিৎসার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা থাকে না।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে যেভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, বস্তিবাসী যে একেবারেই আক্রান্ত হচ্ছে না, তা বলা যায় না। কারণ অনেকের জ্বর হলেও হাসপাতালে যায় না। ফলে আক্রান্তের সংখ্যাও জানা যায় না। ডেঙ্গু থেকে রক্ষার জন্য এখনই তাদের গুরুত্বের সাথে নজর দিতে হবে, তাদেরকে নতুন করে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।”