কেউ কিশোর, কেউ তরুণ, আবার অনেকে মধ্যবয়সী। সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। এসব আহতের কেউ সরাসরি গুলি, কেউ বা ছররা গুলিতে বিদ্ধ হন। কারো হাতে, কারো পেটে, কারো বা পায়ে গুলি লেগেছে। যাদের বেশিরভাগই পঙ্গুত্বের শিকার হতে পারেন। অনিশ্চিত এক জীবনের কথা ভেবে আহত ও তাদের স্বজনদের চোখে মুখে অসহায়ত্ব।
এই চিত্র রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালের। যেখানে প্রায় ছয়দিন আগে পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি হওয়া শাওন শেখ (২১) এখন বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন । রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শিক্ষার্থীর নাকে ক্যানুলা লাগানো। শরীরে একাধিক ব্যান্ডেজ। কথা বলতে পারছেন না। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।
শাওন শেখের মামা সুজন মোল্লা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গত ১৯ জুলাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেদিন ভাগিনা শাওন আজমপুর ছিল। পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার সময় গুলি ছুঁড়তে থাকলে একটি গুলি শাওনের পেটে এসে লাগে। ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করন আনা হয় হাসপাতালে।”
সুজন মোল্লা বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের অনেক মেরেছে। গুলিও ছুঁড়েছে। ভাগিনার মাথায় ইটের আঘাত লেগেছে, পায়ে রাবার বুলেট লেগেছে। এরপর পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। আল্লাহ ছেলেটিকে যে বেঁচে রেখেছে সেটাই অনেক বড় পাওয়া।”
শাওন শেখের মতো গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন যোবায়ের আহমেদ নামে আরেক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, “ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে আমরা রাজপথে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছিলাম। তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীসহ দুর্বৃত্তরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। গুলি করা হয়। আমিও গুলিবিদ্ধ হই। আমাদের অনেক ভাইকে গুলি করা হয়েছে।”
গুলিবিদ্ধ হয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নাজমুল নামে আরেক শিক্ষার্থী। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। সহিংসতা কখনই চাইনি। অথচ এখন গুলিবিদ্ধ হয়ে ব্যথায় কাতরাতে হচ্ছে হাসপাতালের বেডে। আমরা বিচার চাই।”
শুধু উত্তরার এসব হাসপাতালেই নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিকেল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজসহ রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বিছানায় এভাবেই কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ ও আহত অনেক শিক্ষার্থী। আত্মীয়-স্বজনদের কান্না আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে এসব হাসপাতালের পরিবেশ।
সরেজমিনে রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, ‘তিল ধারনের ঠাঁই নেই’। আহত রোগী আর স্বজনদের ভিড় বেড থেকে মেঝে, বারান্দা অবধি। যারা বেড পাননি তারা মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে চিকিৎসেবা নিচ্ছেন। আবার অনেকে বারান্দাতেও আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আবার বেড পাওয়ার আশায় বিভিন্ন জনের কাছে তদবির করছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৫ জুলাই থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই সহিংসতায় শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থী, তরুণ-প্রবীণ, নারী ও পুলিশ এবং সাংবাদিকসহ বহু মানুষআহত হয়েছেন। এরমধ্যে সংঘাতের সময় ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় অন্তত ২০৬ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) তথ্য অনুযায়ী, গত সাত দিনে প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষ সেখানে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। ভর্তি রয়েছেন আরও ৪১০ জন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৭৫ জন। সংহিসতার শিকার ৬০ জনকে মৃত অবস্থায় সেখানে নেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরও ১৯ জন।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যমতে, কয়েকদিনে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন দেড় শতাধিক আহত। বর্তমানে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬৬ জন। যাদের সবাই গুলিবিদ্ধ। চিকিৎসাধীন ১৬ জনের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক একক গুলিতে আর বাকিরা ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন।
একই চিত্র আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের। চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৪ জন। যাদের মধ্যে ২৭৮ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকেও এসেছেন।
চিকিৎসকরা জানান, গুলিবিদ্ধদের মধ্যে পঙ্গু হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার চোখে গুলিবিদ্ধদের অনেকে অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। অল্প আহতরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তবে যাদের রক্তক্ষরণসহ অঙ্গ গুলিবিদ্ধ হয়ে সিরিয়াস ছিলেন তাদের বেডসহ আইসিইউ ও এইচডিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সহিংসতার ঘটনায় ৪২৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৭৮ জনের অপারেশন হয়েছে। তাদের পরবর্তী সময়ে ফলোআপে আসতে বলা হয়েছে।”
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) পরিচালক ও অর্থোপেডিক্স সার্জারির অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, “প্রতিটি রোগীর একাধিক অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। তারা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। রোগীর ক্ষত স্থানের অবস্থা দেখে পর্যায়ক্রমে অস্ত্রোপচারের সময় নির্ধারণ করা হবে।”