• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
মূল্যস্ফীতির চাপ

সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছে মানুষ


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩, ০৯:৫৮ পিএম
সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছে মানুষ
প্রতীকী ছবি

সালমা বেগম (ছদ্মনাম)। স্বামী ও দুই সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবার তাদের। চলতি বছরের শুরুতে তারা স্বামী-স্ত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তবে স্বামীর চাকরি যাওয়ার পর সংসার চালানোর ভার তার কাঁধেই পড়ে। স্বামী কিছু একটা করে সামান্য আয় করলেও পরিবার চালানোর পুরো ব্যয় তার চাকরির রোজগার থেকেই মেটাতে হয়। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটি সঞ্চয়পত্রে কিছু টাকা জমা করেছিলেন তারা। কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় সেই সঞ্চয়পত্র ভাঙতে হয় তাদের।

সালমা বেগম (ছদ্মনাম) সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দেশের পরিস্থিতি ভালো না। দিন যত যাচ্ছে সংসারের ব্যয় আরও বাড়ছে। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দুজনে উপার্জন করেও মাস শেষে সঞ্চয়ের জন্য কোনো টাকা রাখতে পারছি না। সন্তানদের স্কুলে মাসিক বেতনও বাড়ছে। সেদিক থেকে একটা প্রভাব সংসারের ওপর পড়ছে।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতি সপ্তাহে বাজারে কোনো না কোনোকিছুর দাম বাড়ছে। দাম এমন বাড়ছে যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তা পরবর্তীতে আমাদের সংসার চালানোর ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটি সঞ্চয়পত্র করেছিলাম, এখন সেটাও ভাঙতে বাধ্য হয়েছি আমরা। কি করবো এখন আমরা অসহায়। ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে কেউ ১ টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। সাহায্য করার শহরও এটা না। তাই বাধ্য হয়ে সঞ্চয়পত্রে জমা হওয়া অর্থ দিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে।”

চলতি বছরের শুরু থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষেরা। তাই জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে নানামুখী সমস্যায় সালমা বেগমের (ছদ্মনাম) মতো সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন আরও অনেকে।

গত জুলাই-আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কিছুটা বাড়ে। ফলে খাতসংশ্লিষ্টরা সঞ্চয়পত্রে যে আশার আলো দেখেছিলেন, তাদের সেই স্বপ্নে আবারও ভাটা পড়েছে। কারণ, নতুন করে সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাওয়ায় সেপ্টেম্বরের মতো অক্টোবরেও বিনিয়োগ কমেছে।

তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে বিক্রির চেয়ে আগের সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪০ কোটির বেশি। অর্থাৎ অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে প্রায় ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরেও বিক্রির চেয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৪৮ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছিল প্রায় ১৪৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছিল। প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় মাস আগস্টে এ বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের বিক্রি সেপ্টেম্বরে এসে ফের ধাক্কা খেয়েছে। তিন মাসের হিসাবে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। ওই তিন মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা (ঋণাত্মক)। অর্থাৎ এই তিন মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।

তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের চার মাসের হিসেবেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রির পরিমাণ হলো ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা (ঋণাত্মক)। অর্থাৎ এ চার মাসেও যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা বেশি আগের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে।

আয় না বেড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন,নির্বাচনকে সামনে রেখে আগে থেকেই বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ। সবকিছুর দাম বেড়েছে। মানুষের জীবিকা নির্বাহে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় আয় বাড়ছে না। তাই এর বড় প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রের ওপর। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে, তাদের অনেকে এখনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন। এছাড়া নানা কড়াকড়ির কারণেও এ সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেকে। ফলে এ খাতে আশানুরূপ বিক্রি বাড়ছে না।

জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সঞ্চয়পত্র স্কিমগুলোতে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদ প্রদান করে সরকার। মেয়াদপূর্তির পরে বিনিয়োগকৃত অর্থও ফেরত প্রদান করা হয়। প্রতিমাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছে। আর সুদের হার হ্রাস ও শর্তের বেড়াজালে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়পত্র কেনার প্রবণতা কমেছে।”

Link copied!