বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকা আসামিদের ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা অব্যাহত আছে। তবে নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠনের দাবি উঠছে। দিন দিন জোরালো হচ্ছে সেই দাবি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ১৫ আগস্টের হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজতে কমিশনের রূপরেখা প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে খুব শিগগিরই তা সংসদে উঠবে। তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের চক্রান্ত উদঘাটনের জন্য কমিশন গঠনে একটি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। তদন্ত এবং নেপথ্যের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিশন গঠন হবে। সরকার এই আইনের খসড়া তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে শিগগিরই এটি সংসদে উপস্থাপন করা হবে।”
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা। তারা বলছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনা হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ (সাবেক উপাচার্য) অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এর সঙ্গে। তিনি বলেন, “১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত নীলনকশা খুঁজে বের করার জন্য একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিশন গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের ষড়যন্ত্র খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের ডিক্লাসিফাইড তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের স্থানীয় উৎস অনুসন্ধান করে বাইরের উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে যাচাই করে পুরো চক্রান্তের ঘটনা জানতে হবে। কিছু মাস্টারমাইন্ড বিদেশ থেকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল, যখন স্থানীয় আততায়ীরা পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল এবং এর পেছনে আমেরিকার বড় হাত রয়েছে বলে ধারণা ছিল। সুতরাং ইতিহাসের স্বার্থে সবকিছুর প্রতি আলোকপাত করা উচিত।”
কমিশন গঠনের গুরুত্ব উল্লেখ করে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের উদাহরণ উল্লেখ করেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে এই জাতীয় তথ্য অনুসন্ধান মিশন গঠন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সাত দিনের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যার বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন, যা বেসরকারিভাবে ওয়ারেন কমিশন নামে পরিচিত।”
অধ্যাপক সিদ্দিক বলেন, “ওয়ারেন কমিশন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে এবং পরে এটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে। যাতে মানুষ হত্যার ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কোনও ব্যক্তি বা কোনও পরিবারের হত্যা নয়, এটি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছিল।” তিনি আরও বলেন, “কমিশন নতুন করে কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, কারণ হত্যাকাণ্ডের অপরাধীরা ইতোমধ্যেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। দেশের জনগণের জানার অধিকার রয়েছে তাদের জাতির পিতাকে কে হত্যা করেছে।”
সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ বদরুল আহসান বলেন, “যারা এই মর্মান্তিক ঘটনার পরিকল্পনা করেছিল, তাদের চিহ্নিত করে দেশের সামনে উন্মোচন করা একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে যেসব বেসামরিক নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়েছে, মৃত বা জীবিত, তাদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে মরণোত্তর বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বদরুল আহসান বলেন, “আমিও মনে করি, যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাঁর সরকারকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের ব্যাপারেও তদন্ত হওয়া উচিত।” তিনি বলেন, “মোশতাকের দখলদার শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে তাদের ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের আহ্বান জানান।”
বিশিষ্ট আইনজীবী ও পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “ফৌজদারি মামলা একটি দীর্ঘ ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটি একটি অসমাপ্ত প্রক্রিয়াও।”
স্বাধীন কমিশন গঠনের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনে কোনও আইনি বা সাংবিধানিক বাধা নেই। আমাদের জানতে হবে কারা পুরো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ।”