বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জোরালো হওয়ার পর থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরশনের মেয়র উধাও। তারা কোথায় আছেন জানেন না কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় ভেঙে পড়েছে নগর সেবা কার্যক্রম। নগর পিতাদের অনুপস্থিতিতে এ মুহূর্তে তারা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলপ্রয়োগ করেছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছে। জবাবে ইট, পাটকেল ও সড়কে অগ্নিসংযোগে ভঙ্গুর দশা সড়ক, ফুটপাত, সড়ক বিভাজক, সড়কবাতিগুলো। এখন নগরীর যত্রতত্র পড়ে রয়েছে আবর্জনার স্তূপ, ইট-পাটকেল এবং গৃহস্থালি বর্জ্য।
সরেজমিন দেখা গেছে, বসিলা ব্রিজ থেকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত সড়কে ইট, পাটকেল ও লাঠিসোঁটা পড়ে রয়েছে। বেড়িবাঁধ থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের সড়ক বিভাজকের বেষ্টনী ভেঙে ফেলা হয়েছে। আর বসিলা ব্রিজ থেকে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পুরো সড়ক ইট-পাটকেল, পাথর, গুলি ও টিয়ারশেলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে। একই চিত্র দেখা গেছে, নিউমার্কেট, শাহবাগ, পল্টন, প্রেস ক্লাব, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল প্রগতি সরণি, মিরপুর-১০ এবং আশপাশের এলাকা, উত্তরাসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকা।
আরও দেখা গেছে, রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার সড়কবাতি অকেজো হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার পর নগরীর অধিকাংশ সড়কে অন্ধকার নেমে আসে। এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে নগরজুড়ে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আইনশৃঙ্খলার কিছুটা অবনতি হওয়ায় মানুষের আতঙ্কও বেড়েছে।
এ ছাড়া এখন ডেঙ্গু মৌসুম চলছে। বিদ্যমান অবস্থায় মশক নিধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্বসহ ১৭ ধরনের সনদ ইস্যু চলছে না। কাউন্সিলর ও আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও অফিস করছেন না। তারা সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হামলার আতঙ্কে রয়েছেন। আর কাউন্সিলররা এলাকাবাসীর দ্বারা অপহৃত হতে পারার ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ অবস্থায় নগর সেবা কার্যক্রম কার্যত বন্ধই বলা চলে।
বুধবার সকালে গুলিস্তান নগর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংক্ষুব্ধ, বঞ্চিত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার কর্মচারীরা নগর ভবনে টহল দিচ্ছেন। মেয়র সেল, বিভাগীয় প্রধানদের দপ্তরে তারা ঘোরাঘুরি করছেন। দীর্ঘদিন যারা নগরভবন পরিচালনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তারা গত দুদিন অফিস খোলা থাকলেও অফিসে আসেননি।
দুপুরের পরে গুলশান নগর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, যথানিয়মে অফিস চলছে। শীর্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস শুরু করেছেন। তবে উপস্থিতি অনেক কম। দীর্ঘদিন যারা নগর ভবন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং নানাভাবে বিতর্কিত তারা অফিসে আসছেন না। সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারেন এমন আতঙ্কে রয়েছেন তারা।
বিকেলে সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শোডাউন লক্ষ্য করা গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির এক কর্মকর্তা জানান, মেয়র দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। আর ফিরবেন বলে মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেসামাল। সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নগর ভবনে টহল দিচ্ছেন, যে কোনো সময় হেনস্তা হতে পারি। এ ভয়ে তারা নগর ভবনে প্রবেশ করতে চাচ্ছেন না। তা ছাড়া তারা নানাভাবে দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন, সেজন্য তারা আসলেই সংক্ষুব্ধদের হাতে অপদস্ত হতে পারেন এমন শঙ্কায় রয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এক প্রকৌশলী জানান, ঢাকা উত্তরের কয়েকজন প্রকৌশলীর সহায়তায় একটি চক্র টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির উৎসব করেছে। কাজ না করে বিল পরিশোধ করেছে। তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। যে যতটুকু অপরাধ করেছে, তাদের ততটুকু শাস্তি পেতেই হবে। এছাড়া যারা বঞ্চিত, তাদের ন্যায্য পাওনাও ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রশাসনকে সেটা নিশ্চিত করতে চাপ প্রয়োগ করা হবে।
ডিএনসিসির সংক্ষুব্ধ কর্মচারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিদ্দিকুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে জানান, বিগত সময়ে ডিএনসিসিতে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এসব বন্ধে মেয়রের কার্যকর তৎপরতা ছিল না। এজন্য মেয়র আবার ফিরে আসুক তা চাই না। মেয়র নগর ভবনে ফিরতে চাইলে তাকে প্রতিহত করা হবে।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার মেয়র দপ্তরের কেউ অফিসে আসেনি। আমরা সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবকে বিভিন্ন অনিয়মের কিছু প্রমাণ দিয়েছি, তদন্ত করতে বলেছি। কাউকে আর কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করতে দেওয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম যুগান্তরকে বলেন, এখন একটা পরিবর্তিত সময়। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে শহরে ছাত্র আন্দোলনের ফলে সড়ক, ফুটপাত এবং সড়কবাতিগুলো ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। নগরীর আবর্জনা সেবা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেক এলাকায় এখনো আবর্জনার স্তূপ জমে রয়েছে।
তিনি বলেন, মেয়র মহোদয় অফিসে আসছেন না। তবে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়েছে। আর্থিক ক্ষমতা তার হাতে। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, ফুটপাত, সড়ক বাতি ও সড়ক বিভাজক এবং অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি হবে, তা বলা যাচ্ছে না। উনি ফিরলে তার নির্দেশনায় কাজ করব, তা না হলে নতুন সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে তখন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, ফুটপাত, সড়কবাতি এবং অন্যান্য ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে।
তিনি জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংক্ষুব্ধ ও নানাভাবে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এটা অবশ্য সংগত ছিল। আমরা তাদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছি। আশাকরি ধাপে ধাপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ছাত্র আন্দোলন এবং বিরাজমান পরিস্থিতি নিরাপত্তা ও অন্যান্য কারণে নগর সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এটা সত্য। আবর্জনা পরিষ্কারের রুটিন কাজ শুরু করা হয়েছে। অন্যান্য কাজও শুরু করা হবে।
তিনি বলেন, মেয়র কোথায় আছেন জানি না। তিনি কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। এখন কার নির্দেশনায় কাজ চলবে, তা এখনো জানি না। দেখা যাক নতুন সরকার কি সিদ্ধান্ত দেয়। নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। তিনি জানান, পরিবর্তিত সময়ে ডিএসসিসির সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। তাদের বঞ্চনা ও কিছু দাবি রয়েছে। তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে।